পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্ৰন্থপরিচয় broዒ “সৌভাগ্যক্রমে আমরা বাল্যকালে বাংলা ভাষায় বিদ্যাশিক্ষা লাভ করিয়াছিলাম। স্বল্প ইংরেজি যাহা শিখিতাম তাহার মধ্য হইতে হৃদয়ের পোষণযোগ্য তৃপ্তিজনক কোনাে রস আকর্ষণ করিবার ক্ষমতা ছিল না। অথচ তৃষ্ণা যথেষ্ট ছিল। কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, একত্র বাধানো বিবিধার্থসংগ্ৰহ, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, বাংলা রবিনসন ক্রুসো, সুশীলার উপাখ্যান, রাজা প্রতাপাদিত্যরায়ের জীবনচরিত, বেতালপঞ্চবিংশতি প্রভৃতি তখনকার কালের গ্রন্থগুলি অনেক এবং আমরা অপরিতৃপ্ত আগ্রহের সহিত ভালোমন্দ সকল গ্ৰন্থই নির্বিচারে পাঠ করিতাম। তরুণ হৃদয়ের সেই স্বাভাবিক ক্ষুধা-উদ্রেকের সময় বঙ্কিমের নবীনা প্রতিভা লক্ষ্মীরূপে সুধাভাণ্ড হন্তে লইয়া আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তখন যে - ‘রচনা এবং সমালোচনা এই উভয় কার্যের ভর বঙ্কিম একাকী গ্ৰহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল** এই মন্তব্যের পরেই সমালোচক-বঙ্কিম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখিতেছেন “সাহিত্যের পক্ষে যাহা-কিছু অযোগ্য, যাহা-কিছু অনাবশ্যক, যাহাতে কিছুমাত্র অবহেলা বা । অক্ষমতা প্রকাশ পাইত তাহাকে তিনি কদাচ মার্জনা করিতেন না। এই-সমস্ত স্বল্পায়ু ক্ষুদ্র প্রাণীদের প্রতি তিনি এমন কঠোর আঘাত এমন সুতীব্ৰ বিদ্রুপ প্রয়ােগ করিতেন যে, অনেক সময় তাহা অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা বলিয়া মনে হইত ; অনেক সময় মনে হইত এই সকল ক্ষীণজীবীদের প্ৰতি বঙ্কিমের প্রবল বাহুর আঘাত যথাযোগ্য নহে। বিশেষত তখনো বাংলা লেখার শৈশব-অভ্যাসগুলি দূর হয় নাই, লেখকেরা তখনো বঙ্কিমের নূতন রাজত্বের কঠিন নিয়মসকল ভালো করিয়া ধারণা করিতে পারে নাই, সে অবস্থায় সহজেই অনেক ক্রটি মার্জনা করিয়া দোষকে কম করিয়া দেখিয়া এবং গুণকে বাড়াইয়া তুলিয়া সাধারণত উৎসাহ এবং প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছা হয়। বঙ্কিমের রাজদণ্ড সেরূপ দুর্বলতা প্রকাশ করে নাই। তিনি নির্দয়ভাবে ঠিক বাছিতে গিয়া গা উজাড় করিবার জো করিয়াছিলেন । “কিন্তু বঙ্কিমের এই নিষ্ঠুরতা- উচ্চ লক্ষ্য, অটল সংকল্প এবং মহৎ পৌরুষের নিষ্ঠুরতা। বৃহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যাহার প্রবল অনুরাগ তিনি সমস্ত বাধাবিয়কে নির্মমভাবে ছেদন করিয়া ফেলেন। র্যাহার আদর্শ অত্যন্ত উন্নত র্তাহার বিচার অনুরূপ কঠিন । “নিজের বাগানের প্রতি যে মালীর যথার্থ অনুরাগ আছে, ছোটােখাটাে কঁাটাগুল্মজঙ্গলকে সে তীক্ষ কোদালি দিয়া সবলে সমূলে উচ্ছিন্ন করিয়া দেয়। যে-সকল ক্ষুদ্র তৃণগুল্মজঙ্গল অনাদরে জন্মে তাহাদিগকে সামান্য বলিয়া উপেক্ষা করা কর্তব্য নহে। কারণ, তাহারা দেখিতে দেখিতে সমস্ত স্থান আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, গুণে না হউক সংখ্যায় প্রধান হইয়া দাড়ায়, ভালোয় মন্দয় এমন একাকার হইয়া যায় যে নির্বাচন করা বড়োই কঠিন হইয়া উঠে । তখন ভালো জিনিস আপন জন্মভূমি হইতে প্ৰাণধারণযোগ্য যথেষ্ট রস পায় না, ক্রমশ শীর্ণ হইয়া আসে। ‘এই কারণে, মন্দ রচনা সাহিত্যের বিচারালয়ে যেরূপ দণ্ড পায়, যে রচনা মন্দ নহে। কিন্তু ভালোও নহে, যাহাতে কোনো ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই, কোনো সৌন্দৰ্য পরিস্ফুট হয় নাই, তাহাও প্রায় অনুরূপ দণ্ডের যোগ্য বলিয়া গণ্য হয় । উভয়ের প্রতিই নির্বাসনের আদেশ প্রচার হইয়া থাকে । “কিন্তু এই কঠিন কার্যের ভার লইতে অনেক সুযোগ্য লেখক কুষ্ঠিত হন। তাহার দুই প্ৰধান কারণ আছে, এক তো কাজটা বড়োই অপ্রিয়, দ্বিতীয়ত অন্যের অপ্রিয় হইতে হয় । Swary 9 gos, S-S