পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় bro বিশেষত এ দােষের অংশ যখন আমাদিগের সকলকেই বহন করিয়া লইতে হইবে তখন ইহার মধ্যে নিজের সান্তুনা বা শ্লাঘার কারণ কিছুই দেখি না। কিন্তু এই অরাজকতার চিত্ৰ মনের মধ্যে অঙ্কিত করিয়া লইলে পাঠকগণ বুঝিতে পরিবেন, সাহিত্যসিংহাসনে কে আমাদের রাজা ছিলেন এবং তঁহার অভাবে সে শাসনভার গ্রহণ করিবার যোগ্য ব্যক্তি কেহই উপস্থিত নাই । ইহাও বুঝিতে পরিবেন, বঙ্কিম যখন আমাদের সাহিত্যতরীর কর্ণধার হইয়াছিলেন তখন তরণী কেন এমন আশ্চর্য বেগে অগ্রসর হইয়াছিল, আর আজই বা কেন সে যথেচ্ছ ভাসিয়া যাইতেছে এবং নানা বাতাসে ঘুরিয়া মরিতেছে । আমাদের কাহারও সে ক্ষমতা নাই, সে সাহস নাই, সে প্রতিভা নাই। আমরা যদি-বা স্ব স্ব শক্তি-অনুসারে কোহ-কেহ কোনো কোনো বিষয়ে উৎকর্ষ লাভ করিতে পারি, কিন্তু বর্তমানের গতিকে নিয়মিত করা, সমস্ত সাহিত্যকে চালনা করা আমাদের সাধ্যায়ত্ত নহে। বঙ্গদর্শন তখনকার সমস্ত বঙ্গসাহিত্যের মর্মস্থলে শ্ৰীস্বরূপে বিরাজ করিতেছিল । এখন সে স্থান শূন্য। সেইজন্য এখনকার সাহিত্যের বিশেষ কোনো আকারপ্রকার দেখা যায় না ; তাহার আয়তন বৃদ্ধি হইতেছে কিন্তু তাহার রূপ নাই ; তাহার কোনো লক্ষণ নাই, আদর্শ নাই, বিবেকশক্তি নাই, তাহার পক্ষে সকল পথই সমান । সংসারযুদ্ধে বঙ্গসাহিত্যের সারথি কৃষ্ণ যেন আজ তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন । “সাহিত্যক্ষেত্রে কৃষ্ণের সহিত আমি আজ বঙ্কিমের তুলনা করিলাম। বঙ্কিমের মহাগ্ৰন্থ “কৃষ্ণচরিত্র পাঠ করিলে লেখকের সহিত লেখকের আদর্শ-চরিত্রের সাদৃশ্য স্বতই মনে উদয় হয় ।” “কৃষ্ণচরিত্র সম্বন্ধে আধুনিক সাহিত্যে স্বতন্ত্র প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করিয়াছেন ; বর্তমান প্ৰবন্ধেও বলিতেছেন “বঙ্কিম যেখানে ইষ্টকের উপর ইষ্টক স্থাপন করিয়া সমুন্নত সুদৃঢ় প্রাসাদ নির্মাণ করিয়াছেন, এখনকার কোনো হৃদয়াধিক্যবিশিষ্ট লেখক সে স্থলে প্রচুর বাম্পোচ্ছাসযোগে বেলুন নির্মাণ করিয়া একেবারে মেঘরাজ্যে ছাড়িয়া দিতেন- কিন্তু সে বেলুন যতই উচ্চে উঠক-না কেন তাহা ভিত্তিহীন, তাহা কিছুকালের জন্য সাধারণের কৌতুহলজনক, কিন্তু বাসযোগ্য নহে, এবং সেই বেলুনযোগে যিনি আপনি যশকে উর্ধে উডভীন করিয়া দিতেন, একদিন আকস্মিক পতনে অপমৃত্যুর জন্য সে যশকে প্রস্তুত হইয়া থাকিতে হইত। ‘বঙ্কিম গীতার উপদেশ-অনুসারে কেবলমাত্র আপনার কর্ম করিয়া গিয়াছেন, ফললাভের প্রতি দৃকপাত করেন নাই। তিনি নিজে কৃষ্ণকে পরিপূর্ণ ভক্তি করিতেন, অথচ আধুনিক কৃষ্ণভক্তদিগকে প্রসন্ন করিবার কোনাে চেষ্টা করেন নাই ; তিনি কৃষ্ণের দেবত্বে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতেন, অথচ বহু যত্নে বহু সাবধানে কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত অলৌকিক অংশ দূর করিয়া দিয়াছেন ; আমাদের দেশের লোকের যে অন্ধভক্তি এবং নির্বিচার অতিবিশ্বাসের দিকে প্রবণতা আছে বঙ্কিম তাহার সমস্ত রচনায় কোথাও তাহার পোষণ বা সমর্থন করেন নাই, বরং প্রতিপদে তাহাকে আঘাত করিয়া গিয়াছেন ।** 曼 “যুক্তিবিচারকে প্রাধান্য না দিয়া বঙ্কিম যদি নিজেই গুরু সাজিয়া দাড়াইতেন অনুসন্ধান-দ্বারা সত্যের দিকে পথ নির্দেশ না করিয়া তিনি যদি নিজেকেই ধ্রুবতারা বলিয়া প্রচার করিতেন, দেশের লোকের মনের গতি বুঝিয়া তিনি যদি অন্ধবিশ্বাস এবং অলৌকিকবাদকে আপন নূতন অবতার হইয়া দাড়াইতে পারিতেন। তবে তাহার অসংখ্য উন্মত্ত শিষ্যগণ এমন নিবিড় ১৯ বর্তমান গ্রন্থের পৃ ৫৩৫, ১৯ ও ২০ ছত্রের অন্তরনিবিষ্ট ছিল।