পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় եՀs মেঘপুঞ্জের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছে, সেই সুরেন্দ্রনাথকে সকলে মিলিয়া প্রকাশ্যভাবে দেশনায়করূপে বরণ করিয়া লইবার জন্য আমি সমস্ত বঙ্গবাসীকে আজ আহবান করিতেছি । সুরেন্দ্রনাথ তাহার নবযৌবনের জ্যোতিঃপ্ৰদীপ্ত প্ৰভাতে দেশহিতের জাহাজে হাল ধরিয়া যেদিন যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলেন সেদিন ইংরেজিশিক্ষাগ্ৰস্ত যুবকগণ একটিমাত্র বন্দরকেই আপনাদের গম্যস্থান বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন- সেই বন্দরের নাম রাজপ্ৰাসাদ । সেখানে আছে সবই- লোকে যাহা-কিছু কামনা করিতে পারে, অন্নবস্ত্ৰ, পদমান, সমস্তই রাজভাণ্ডারে বোঝাই করা রহিয়াছে । আমরা ফর্দ ধরিয়া ধরিয়া উচ্চস্বরে চাহিতে আরম্ভ করিলাম- ডাঙা হইতে উত্তর আসিল, ‘এসো-না, তোমরা নামিয়া আসিয়া লইয়া যাও ।” কিন্তু আমাদের নামিবার ঘাট নাই ; আর-আর সমস্ত বড়ো বড়ো জাহাজে পথ আটক করিয়া নোঙর ফেলিয়া বসিয়া আছে, তাহারা এক-ইঞ্চি নড়িতে চায় না । এ দিকে ফর্দ আওড়াইতে আওড়াইতে আমাদের গলা ভাঙিয়া গেল, দিন অবসান হইয়া আসিল । কখনো বা রাগ করিয়া যাহা মুখে আসে তাঁহাই বলি, কখনো বা চোখের জলে কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসে। কেহ নিষেধও করে না, কেহ পথও ছাড়ে না ; বাধাও নাই, সুবিধাও নাই। আর-আর সকলে দিব্য কেনাবেচা করিয়া যাইতেছে, নিশান উড়িতেছে, আলো জ্বলিতেছে, ব্যান্ড বাজিতেছে। আমরা সন্ধ্যাকাশের অবিচলিত নক্ষত্ররাজি ও রাজবাতায়নের অনিমেষ দীপমালার প্রতি লক্ষ করিয়া সকলের পশ্চাৎ হইতে আমাদের “দরিদ্রাণাং মনোরথাঃ’ অক্ষুন্ন অধ্যবসায়ের সহিত অবিশ্রাম নিবেদন করিয়া চলিলাম । এইভাবে কত দিন, কত বৎসর কাটিত তাহা বলিতে পারি না- এমন সময় এই নিঃসহ নিশ্চলতার মধ্যে বিধাতার কৃপায় পশ্চিম আকাশ হইতে হঠাৎ একটা বড়োরকম ঝড় উঠিল । আমাদের দেশহিতের জাহাজটাকে পুবের মুখে হুহু করিয়া ছুটাইয়া চলিল ; অবশেষে যেখানে আসিয়া তীর পাইয়া বঁচিয়া গেলাম, চাহিয়া দেখিলাম, সে যে আমাদের ঘরের ঘাট । সেখানে নিশান উড়ে না, ব্যান্ড বাজে না, কিন্তু পুরলক্ষ্মীরা যে হুলুধ্বনি দিতেছেন, দেবালয়ে যে মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়া উঠিল । এতদিন অভুক্ত থাকিয়া পরের পাকশালা হইতে কেবল বড়ো-বড়ো ভোজের গন্ধটা পাইতেছিলাম, আজ যে দেখিতে দেখিতে সম্মুখে পাত পাড়িয়া দিল । আমরা জানিতাম না, এ যজ্ঞে আমাদের মাতা আমাদের জন্য এতদিন সজলচক্ষে অপেক্ষা করিয়া ছিলেন । তিনিই আজ দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে সুরেন্দ্রনাথের শিরশচুম্বন করিয়া তঁহাকে আপন কোলের দিকে পাথরে-বাধানো সোনার দ্বীপে এমন সুস্নিগ্ধ সার্থকতা এক দিনের জন্যও লাভ করিয়াছেন ? এমন আশাপরিপূর্ণ অমৃতবাণী স্বপ্নেও শুনিয়াছেন ? বিধাতার কৃপাঝড়ে সুরেন্দ্রনাথের সেই জাহাজকে যে ঘাটে আনিয়া ফেলিয়াছে ইহার নাম আত্মশক্তি । এইখানে যদি আমরা কেনাবেচা করিতে পারিলাম তো পারিলাম ; নতুবা অতলস্পর্শ লবণাম্বুগর্ভে ডুবিয়া মরাই আমাদের পক্ষে শ্রেয় হইবে। “কাপ্তেন এখানকার প্রত্যেক ঘাটে ঘাটে আমাদের বিস্তর লেনদেনা করিবার আছে- শিক্ষাদীক্ষা সুখস্বাস্থ্য অন্নবস্ত্ৰ সমস্ত আমাদিগকে বোঝাই করিয়া লইতে হইবে- এবারে আর সেই রাজ-অট্টালিকার শূন্যগর্ভ গুম্বজটার দিকে একদৃষ্টিতে দূরবীণ কষিয়া নােঙর ফেলিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। আমরা আজ যে-যাহার ছােটােখাটাে মূলধন হাতে করিয়া ছুটিয়া আসিয়াছি— এবারে আর বঁাধাবন্দরে পুনঃপুন বন্দনাগীত গাওয়া নয়- এবার পাহাড় বঁাচাইয়া ঝড় কাটাইয়া আমাদিগকে পার করিতে হইবে কাপ্তেন । তোমার উপরে অনেকের ভরসা আছে- হাল ধরিয়া তোমার হাত শক্ত, ঢেউ খাইয়া তোমার হাড় পাকিয়াছে। এতদিন যে নামের দোহাই পাড়িতে পাড়িতে দিন কাটিয়া গেল সে নাম ছাড়িয়া আজ যথার্থ কাজের পথে পাড়ি দিবার বেলায় ঈশ্বরের নাম করো, আমরাও এককণ্ঠে তাহার জয়োচ্চারণ করিয়া সকলে তোমার চতুর্দিকে সম্মিলিত হই।” ।