পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br&& রবীন্দ্র-রচনাবলী

    • আপনাদের যদি অভিমত হয়, তবে আর কালবিলম্বমাত্র না করিয়া বঙ্গদেশের এই মঙ্গলমহাসনে সুরেন্দ্রনাথের অভিষেক করি। জানি, এরূপ কোনাে প্রস্তাব কখনােই সর্ববাদিসম্মত হইতেই পারে না, কিন্তু তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিলে চিরদিন কেবল অপেক্ষা করিয়াই

তাহারা এই কাজ আরম্ভ করিয়া দিন । তাহারা সুরেন্দ্রনাথকে সমস্ত ক্ষুদ্রবন্ধন হইতে মুক্ত করুন, তাহাকে দেশনায়কের উপযুক্ত গৌরবরক্ষার সামর্থ্য দিন, সকলের যোগ্যতা মিলিত করিয়া র্তাহাকে এই পদের যোগ্য করিয়া তুলুন ।

    • ৰ্যাহারা সাধক, র্যাহারা দেশের গুরু, তাহারা খ্যাতিপ্ৰতিপত্তির অপেক্ষা না। রাখিয়া, বিরোধ-অবমাননার আশঙ্কা স্বীকার করিয়াও দেশের মতি ফিরাইতে চেষ্টা করিবেন- আর র্যাহারা দেশের নায়ক তাহারা দেশকে গতিদান করিবেন | যে-সকল জাতি স্থির হইয়া বসিয়া নাই, যাহারা চলিতেছে, তাহারা এইভাবেই চলিতেছে । এক দল উপর হইতে তাহদের শুভবুদ্ধিকে নিয়মিত করিতেছে, আর-এক দল বক্ষের মধ্যে থাকিয়া তাহদের প্রাণশক্তি ক্তিকে প্রবর্তিত করিতেছে । এই উভয় দলের পরস্পরে অনেক সময়েই একমত হয় না, কিন্তু তাই বলিয়া যাহারা চালাইতেছে তাহাদের বসিয়া থাকিলে চলে না। কারণ, শিক্ষা শুধু উপদেশে নহে, চলার মধ্যেই শিক্ষা আছে ।

অতএব এতদিন যে সুরেন্দ্রনাথ বিনা নিয়োগে নিজের ক্ষমতাবলেই দেশকে সাধারণাহিতের প্ৰস্তাব আমি উত্থাপন করিতেছি । নিয়োগপত্র দিলে তাহার ক্ষমতা সুনিশ্চিত এবং তঁহার দায়িত্ব গভীরতর হইবে এবং তিনি কেবলমাত্র শিক্ষিতসম্প্রদায়ের ইংরেজিবিদ্যার অভ্যস্ত বুলির প্রতি কৰ্ণপাত না করিয়া আমাদের এই পুরাতন দেশের চিরন্তন প্ৰকৃতির প্রতি মনোযোগ করবেনযে-সকল পদার্থ পরদেশের সজীব কলেবারের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যথাস্থান হইতে ভ্ৰষ্ট হইলে এ দেশে যাহা অসংগত আবর্জনারূপে গণ্য হইবে, অনুকরণের মোহে তাহাকে তিনি আদর করিবেন না । বিরোধমূলক যে সংগ্রামশীলতা যুরোপীয় সভ্যতার স্বভাবগত, যাহা কখনোই এ দেশের মৃত্তিকায় মূলবিস্তার করিয়া ফলবান হইবে না, তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া যে মঙ্গলময় মিলনপরতা, যে অবিচলিত ধর্মনিষ্ঠা ভারতবর্ষের চিরকালীন সাধনা, তাহাকেই বর্তমান কালের অবস্থান্তরের সহিত তিনি সংগত করিয়া লইবার চেষ্টা করিবেন । কিন্তু তিনি কী করিবেন না-করিবেন। এ স্থলে তাহা অনুমান ও আলোচনা করা বৃথা- কেবল ইহাই সত্য যে, তাহার করার মধ্যে আমাদেরই কম প্রকাশ পাইবে, দেশ তাঁহারই মধ্য দিয়া নিজেকে ব্যক্ত করিবে, তাহারই এক হস্ত-দ্বারা নিজের প্ৰাপ্য গ্ৰহণ করিবে ও তাহারই অন্য হস্ত-দ্বারা নিজের দান বিতরণ করিবে- ধর্মবিরুদ্ধ না হইলে, সত্যকে লঙঘন না করিলে ইহার বিরুদ্ধে আমরা বিদ্রোহ করিব না এবং এই নিয়ম ও নিয়ন্তাকে, স্বেচ্ছাকৃত সুতরাং অলঙঘ্য বাধ্যতা-সহকারে মান্য করাই আমাদের প্রত্যেকের পক্ষে আত্মসম্মান বলিয়া গণ্য হইবে । এইরূপে সমস্ত বলক্ষয়কর দ্বিধা ও সমস্ত আত্মাভিমানের কুশকণ্টক সবলে উৎপাটিত করিয়া যদি একের মধ্যে আমরা আমাদিগকে নিবিড়ভাবে একত্র করিতে পারি, তবে আর আমাদিগকে নিজের শক্তির অহংকার করিবার জন্য সর্বদা আস্ফালন করিতে হইবে না, পরের বিমুখতাকে ফিরাইবার জন্য প্ৰাণপণে অত্যূক্তির সৃষ্টি করিতে হইবে না- তবেই আমরা শান্তভাবে, বলিষ্ঠ ও ধীরভাবে মহৎ হইতে পারিব এবং নিজের দেশের মধ্যে নিজের যথার্থ স্থানটি অধিকার করিয়া কর্মগৌরবের মধ্যে সার্থকতা প্ৰাপ্ত হইয়া পোলিটিকাল । ৪৩ পি ৬৯৫, ৩৯ ছত্রের পর । 88 পা ৬৯৬, ২৯ ছত্রের পর ।