পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অবতরণিকা [०१ সব চেয়ে কাচা । আমার ছন্দগুলি লাগাম-ছেড়া, লেখবার বিষয় ছিল অস্ফুট উক্তিতে ঝাপসা, ভাষার ও ভাবের অপরিণতি পদে পদে । তখনকার সাহিত্যিাকেরা মুখের কথায় বা লেখায় প্রায়ই আমাকে প্রশ্রয় দেন নি— আধো-আধো বাধো-বাধো কথা নিয়ে বেশ একটু হেসেছিলেন । সে হাসি বিদূষকের নয়, সেটা বিদূষণ-ব্যবসায়ের অঙ্গ ছিল না । তাদের লেখায় শাসন ছিল, অসৌজন্য ছিল না লেশমাত্র । বিমুখত যেখানে প্ৰকাশ পেয়েছে সেখানেও বিদ্বেষ দেখা দেয় নি । তাই প্রশ্রয়ের অভাব সত্ত্বেও, বিরুদ্ধ রীতির মধ্য দিয়েও, আপনি লেখা আপন মতে গড়ে তুলেছিলেম । সেদিনকার খ্যাতিহীনতার স্নিগ্ধ প্রথম প্রহর কেটে গেল। প্রকৃতির শুশুনা ও আত্মীয়দের স্নেহের ঘনচ্ছায়ায় ছিলেম বসে । কখনো কাটিয়েছি। তেতালার ছাদের প্রান্তে কর্মহীন অবকাশে মনে মনে আকাশ-কুসুমের মালা গেথে, কখনো গাজিপুরে বৃদ্ধ নিমগাছের তলায় বসে ইদারার জলে বাগান সেচ দেবার করুণধ্বনি শুনতে শুনতে অদূর গঙ্গার স্রোতে কল্পনাকে অহৈতুক বেদনায় বোঝাই করে দূরে ভাসিয়ে দিয়ে । নিজের মনের আলো-আধারের মধ্যে থেকে হঠাৎ পরের মনের কনুইয়ের ধাক্কা খাবার জন্যে বড়ো রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হবে এমন কথা সেদিন ভাবিও নি। অবশেষে একদিন খ্যাতি এসে অনাবৃত মধ্যাহ্নরৌদ্রে টেনে বের করলে । তাপ ক্রমেই বেড়ে উঠল, আমার কোণের আশ্রয় একেবারে ভেঙে গেল । খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে যে গ্লানি এসে পড়ে আমার ভাগে অন্যদের চেয়ে তা অনেক বেশি আবিল হয়ে উঠেছিল । এমন অনবরত, এমন অকুষ্ঠিত, এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসম্মাননা আমার মতো আর কোনো সাহিত্যিককেই সইতে হয় নি । এও আমার খ্যাতি-পরিমাপের বৃহৎ মাপকাঠি । এ কথা বলবার সুযোগ পেয়েছি যে, প্রতিকূল পরীক্ষায় ভাগ্য আমাকে লাঞ্ছিত করেছে, কিন্তু পরাভাবের আগৌরবে লজ্জিত করে নি । এ ছাড়া আমার দুরগ্রহ কলো বর্ণের এই যে পটটি ঝুলিয়েছেন এরই উপরে আমার বন্ধুদের সুপ্ৰসন্ন মুখ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাদের সংখ্যা অল্প নয়, সে কথা বুঝতে পারি। আজকের এই অনুষ্ঠানেই । বন্ধুদের কাউকে জানি, অনেককেই জানি নে । তারাই কেউ কাছে থেকে কেউ দূরে থেকে এই উৎসবে মিলিত হয়েছেন, সেই উৎসাহে আমার মন আনন্দিত । আজ আমার মনে হচ্ছে তারা আমাকে জাহাজে তুলে দিতে ঘাটে এসে দাড়িয়েছেন— আমার খেয়াতরী পাড়ি দেবে দিবালোকের পরপারে তাদের মঙ্গলধ্বনি কানে নিয়ে । আমার কর্মপথের যাত্ৰা সত্তর বছরের গোধূলিবেলায় একটা উপসংহারে এসে পৌঁছল। আলো স্নান হবার শেষ মুহুর্তের এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের দ্বারা দেশ আমার দীর্ঘজীবনের মূল্য স্বীকার করবেন। dh ফসল যতদিন মাঠে ততদিন সংশয় থেকে যায় । বুদ্ধিমান মহাজন খেতের দিকে তাকিয়েই আগাম দাদন দিতে দ্বিধা করে, অনেকটা হাতে রেখে দেয় । যখন গোলায় উঠল তখনই ওজন কৃষ্ণ দামের কথা পাকা হতে পারে। আজ আমার বৃক্ত সেই ফলন শেষের হিসাব ঢুকিয়ে দেবার যে মানুষ অনেক কাল বেঁচে আছে সে অতীতেরই শামিল। বুঝতে পারছি, আমার সাবেক বর্তমান এই হাল বর্তমান থেকে বেশ খানিকটা তফাতে । যে-সব কবি পালা শেষ করে লোকান্তরে তাদেরই আঙিনার কাছটায় আমি এসে দাঁড়িয়েছি, তিরোভাবের ঠিক পূর্ব-সীমানায় । বর্তমানের চলতি রথের বেগের মুখে কাউকে দেখে নেবার যে অস্পষ্টতা সেটা আমার বেলা এতদিনে কেটে যাবার কথা । যতখানি দূরে এলে কল্পনার ক্যামেরায় মানুষের জীবনটাকে সমগ্ৰলক্ষ্যবদ্ধ করা যায় আধুনিকের পুরোভাগ থেকে আমি ততটা দূরেই এসেছি । পঞ্চাশের পরে বানপ্রন্থের প্রস্তাব মনু করেছেন । তার কারণ মনুর হিসাবমত পঞ্চাশের পরে