পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অবতরণিকা (Sà তাৎপর্য নিয়ে । আমাকে গ্ৰহণ করার দ্বারা দেশ যদি কোনো ভাবে নিজেকে লাভ না করে থাকে তবে আজকের এই উৎসব অর্থহীন । যদি কেউ এ কথায় অহংকারের আশঙ্কা করে আমার জন্যে উদবিগ্ন হন তবে তাদের উদবেগ অনাবশ্যক। যে খ্যাতির সম্বল অল্প তার সমারোহ যতই বেশি হয়, ততই তার দেউলে হওয়া দ্রুত ঘটে । ভুল মস্ত হয়েই দেখা দেয়, চুকে যায় অতি ক্ষুদ্র হয়ে | আতশবাজির অভ্ৰবিদারক আলোটাই তার নির্বাণের উজ্জ্বল তর্জনীসংকেত । এ কথায় সন্দেহ নেই যে, পুরস্কারের পাত্ৰ-নির্বাচনে দেশ ভুল করতে পারে । সাহিত্যের ইতিহাসে ক্ষণমুখরা খ্যাতির মৌনসাধন বার বার দেখা গেছে । তাই আজকের দিনের আয়োজনে আজই অতিশয় উল্লাস যেন না করি, এই উপদেশের বিরুদ্ধে যুক্তি চলে না । তেমনি তা নিয়ে এখনই তাড়াতাড়ি বিমর্ষ হবারও আশু কারণ দেখি না । কালে কালে সাহিত্যাবিচারের রায় একবার উলটিয়ে আবার পালটিয়েও থাকে । অব্যবস্থিতচিত্ত মন্দগতি কালের সবশেষ বিচারে আমার ভাগ্যে যদি নিঃশেষে ফাকিই থাকে। তবে এখনই আগাম শোচনা করতে বসা কিছু নয় । এখনকার মতো এই উপস্থিত অনুষ্ঠানটাই নগদ লাভ । তার পরে চরম জবাবদিহির জন্যে প্রপৌত্রেরা রইলেন । আপাতত বন্ধুদের নিয়ে আশ্বস্তচিত্তে আনন্দ করা যাক, অপর পক্ষে যাদের অভিরুচি হয় তারা ফুৎকারে বুদবুদ বিদীর্ণ করার উৎসাহে আনন্দ করতে পারেন । এই দুই বিপরীত ভাবের কালোয় সাদায় সংসারের আনন্দধারায় যমের ভগ্নী যমুনা ও শিবজটানিঃসৃত গঙ্গা মিলে থাকে। ময়ূর আপনি পুচ্ছগর্বে নৃত্য করে খুশি, আবার শিকারি আপনি লক্ষাবোধগর্বে তাকে গুলি করে মহা আনন্দিত । আধুনিক কালে পাশ্চাত্য দেশে সাহিত্যে কলাসূষ্টিতে লোকচিত্তের সম্মতি অতি ঘন ঘন বদল হয়, এটা দেখা যাচ্ছে । বেগ বেড়ে চলেছে মানুষের যানে-বাহনে, বেগ অবিশ্রাম ঠেলা দিচ্ছে মানুষের মনপ্রাণকে । যেখানে বৈষয়িক প্রতিযোগিতা উগ্র সেখানে এই বেগের মূল্য বেশি । ভাগ্যের হরির লুট নিয়ে হাটের ভিড়ে ধুলার পরে যেখানে সকলে মিলে কড়াকড়ি, সেখানে যে মানুষ বেগে জেতে মালেও তার জিত । তৃপ্তিহীন লোভের বাহন বিরামহীন বেগ । সমস্ত পশ্চিম মাতালের মতো টলমল করছে সেই লোভে । সেখানে বেগবৃদ্ধি ক্ৰমে লাভের উপলক্ষ না হয়ে স্বয়ং লক্ষ্য হয়ে উঠছে। বেগেরই লোভ আজ জলে স্থলে আকাশে হিস্টিরিয়ার চীৎকার করতে করতে ছুটে বেরোল । কিন্তু প্ৰাণপদার্থ তো বাষ্পবিদ্যুতের-ভূতে-তাড়া-করা লোহার এঞ্জিন নয় । তার একটি আপন ছন্দ আছে। সেই ছন্দে দুই-এক মাত্রা টান সয়, তার বেশি নয় । মিনিট কয়েক ডিগবাজি খেয়ে চলা সাধ্য হতে পারে, কিন্তু দশ মিনিট যেতে না যেতে প্ৰমাণ হবে যে মানুষ বাইসিকেলের চাকা নয়, তার পদাতিকের চাল পদাবলীর ছন্দে । গানের লয় মিষ্টি লাগে যখন সে কানের সজীব ছন্দ মেনে চলে । তাকে দুন থেকে চৌদুনে চড়ালে সে কলাদেহ ছেড়ে কৌশলদেহ নেবার জন্যই হাসফাস করতে থাকে । তাগিদ যদি আরো বাড়াও তা হলে রাগিণীটা পাগলা-গারদের সদর গেটের উপর মাথা ঠুকে মারা যাবে। সজীব চোখ তো ক্যামেরা নয়, ভালো করে দেখে নিতে সে সময় নেয় । ঘণ্টায় বিশ-পচিশ মাইল দৌড়ের দেখা তার পক্ষে কুয়াশা দেখা । একদা তীর্থযাত্রা বলে একটা সজীব পদার্থ আমাদের দেশে ছিল, ভ্রমণের পূর্ণস্বাদ নিয়ে সেটা সম্পন্ন হত । কলের গাড়ির আমলে তীর্থ রইল, যাত্রা রইল না ; ভ্ৰমণ নেই, পৌছনো আছে- শিক্ষাটা বাদ দিয়ে পরীক্ষাটা পাস করা যাকে বলে । রেল- কোম্পানির কারখানায় কলেঠাসা তীর্থযাত্রার ভিন্ন ভিন্ন দামের বটিকা সাজানো, গিলে ফেললেই হল- কিন্তু হলই না যে, সে কথা বোঝবারও ফুরসত নেই। কালিদাসের যক্ষ যদি মেঘদূতকে বরখাস্তু করে দিয়ে এরোপ্লেন-দূতকে অলকায় পাঠাতেন তা হলে আমন দুই-সর্গ-ভরা মন্দাক্রান্ত ছন্দ দু-চারটে শ্লোক পার না হতেই অপঘাতে মরত ।