পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রথম পরিচ্ছেদ । রাত্রি অনেক হইয়াছে। গ্ৰীষ্মকাল । বাতাস বন্ধ হইয়া গিয়াছে। গাছের পাতাটিও নড়িতেছে না । আছেন । তাহার পার্থে তাহার স্ত্রী সুরমা । সুরমা কহিলেন, “প্রিয়তম, সহ্য করিয়া থাকো, ধৈর্য ধরিয়া থাকে। একদিন সুখের দিন আসিবে ।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমি তো আর-কোনো সুখ চাই না । আমি চাই, আমি রাজপ্রাসাদে না যদি জন্মাইতাম, যুবরাজ না যদি হইতাম, যশোহর-অধিপতির ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম প্রজার প্রজা হইতাম ! তার জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ— তাহার সিংহাসনের, তাহার সমস্ত ধন মান যশ প্রভাব গৌরবের একমাত্র উত্তরাধিকারী না হইতাম ! কী তপস্যা করিলে এ-সমস্ত অতীত উলটাইয়া যাইতে পারে !” সুরমা অতি কাতর হইয়া যুবরাজের দক্ষিণ হস্ত দুই হাতে লইয়া চাপিয়া ধরিলেন, ও তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন । যুবরাজের ইচ্ছা পুরাইতে প্ৰাণ দিতে পারেন, কিন্তু প্ৰাণ দিলেও এই ইচ্ছা পুরাইতে পরিবেন না। এই দুঃখ । যুবরাজ কহিলেন, “সুরমা, রাজার ঘরে জন্মিয়াছি বলিয়াই সুখী হইতে পারিলাম না । রাজার ঘরে সকলে বুঝি কেবল উত্তরাধিকারী হইয়া জন্মায়, সন্তান হইয়া জন্মায় না । পিতা ছেলেবেলা হইতেই আমাকে প্রতি মুহুর্তে পরখ করিয়া দেখিতেছেন, আমি তাহার উপার্জিত যশোমান বজায় রাখিতে পারিব কি না, বংশের মুখ উজ্জ্বল করিতে পারিব কি না, রাজ্যের গুরুভার বহন করিতে পারিব কি না । আমার প্রতি কাৰ্য, প্ৰতি অঙ্গভঙ্গি তিনি পরীক্ষার চক্ষে দেখিয়া আসিতেছেন, মেহের চক্ষে নহে । আত্মীয়বর্গ, মন্ত্রী, রাজসভাসদগণ, প্রজারা আমার প্রতি কথা প্রতি কাজ খুঁটিয়া খুঁটিয়া লইয়া আমার ভবিষ্যৎ গণনা করিয়া আসিতেছে। সকলেই ঘাড় নাড়িয়া কহিল- না, আমার দ্বারা এ বিপদে রাজ্য রক্ষা হইবে না। আমি নির্বোধি, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না । সকলেই আমাকে অবহেলা করিতে লাগিল, পিতা আমাকে ঘূণা করিতে লাগিলেন । আমার আশা একেবারে পরিত্যাগ করিলেন। একবার খোজও লাইতেন না ।” সুরমার চক্ষে জল আসিল । সে কহিল, “আহা ! কেমন করিয়া পারিত !” শুরু দুখ হইল, তাহার রাগ হইল, সে কহিল,"তােমাকে যাহারা নির্বািধ মনে করত তাহারাই "ן & উদয়াদিত্য ঈষৎ হাসিলেন, সুরমার চিবুক ধরিয়া তাহার রোষে আরক্তিম মুখখানি নাড়িয়া দিলেন । মুহূর্তের মধ্যে গভীর হইয়া কহিলেন, “না সুরমা, সত্য সত্যই আমার রাজ্যশাসনের বুদ্ধি নাই । তাহার যথেষ্ট পরীক্ষা হইয়া গেছে । আমার যখন ষোলো বৎসর বয়স তখন মহারাজ কাজ শিখাইবার জন্য হােসেনখালি পরগনার ভার আমার হাতে সমর্পণ করেন । ছয় মাসের মধ্যেই বিষম বিশৃঙ্খলা ঘটিতে লাগিল । খাজনা কমিয়া গেল, প্ৰজারা আশীর্বাদ করিতে লাগিল । কর্মচারীরা আমার বিরুদ্ধে রাজার নিকটে অভিযোগ করিতে লাগিল । রাজসভার সকলেরই মত হইল, যুবরাজ প্রজাদের যখন অত প্রিয়পাত্র হইয়া পড়িয়াছেন তখনই বুঝা যাইতেছে। উহার দ্বারা রাজ্যশাসন কখনো ঘটিতে পরিবে না । সেই অবধি মহারাজ আমার পানে আর বড়ো একটা তাকাইতেন না । বলিতেন- ও কুলাঙ্গার ঠিক