পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V9 Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী রায়গড়ের খুড়া বসন্ত রায়ের মতো হইবে, সেতার বাজাইয়া নাচিয়া বেড়াইবে ও রাজ্য অধঃপাতে দিবে ।” সুরমা আবার কহিলেন, “প্রিয়তম, সহ্য করিয়া থাকো, ধৈর্য ধরিয়া থাকে। হাজার হউন, পিতা তো বটেন । আজকাল রাজ্য-উপার্জন রাজ্যবৃদ্ধির একমাত্র দুরাশায় তাহার সমস্ত হৃদয় পূর্ণ রহিয়াছে, সেখানে স্নেহের ঠাই নাই। যতই তাহার আশা পূর্ণ হইতে থাকিবে ততই তাহার স্নেহের রাজ্য বাড়িতে থাকিবে ।” যুবরাজ কহিলেন, “সুরমা, তোমার বুদ্ধি তীক্ষ, দূরদশী ; কিন্তু এইবারে তুমি ভুল বুঝিয়াছ। এক তো আশার শেষ নাই ; দ্বিতীয়ত পিতার রাজ্যের সীমা যতই বাড়িতে থাকিবে, রাজ্য যতই লাভ করিতে থাকিবেন, ততই তাহা হারাইবার ভয় তাহার মনে বাড়িতে থাকিবে- রাজকাৰ্য যতই গুরুতর সুরমা ভুল বুঝে নাই, ভুল বিশ্বাস করিত মাত্র ; বিশ্বাস বুদ্ধিকেও লঙঘন করে । সে একমনে আশা করিত, এইরূপই যেন হয় । “চারি দিকে কোথাও বা কৃপাদৃষ্টি কোথাও বা অবহেলা সহ্য করিতে না পারিয়া আমি মাঝে মাঝে পালাইয়া রায়গড়ে দাদামহাশয়ের কাছে। যাইতাম । পিতা বড়ো একটা খোজ লইতেন না । আঃ, সে কী পরিবর্তন ! সেখানে গাছপালা দেখিতে পাইতাম, গ্রামবাসীদের কুটিরে যাইতে পারিতাম, দিবানিশি রাজবেশ পরিয়া থাকিতে হইত না । তাহা ছাড়া জান তো, যেখানে দাদামহাশয় থাকেন তাহার ত্ৰিসীমায় বিষাদ ভাবনা বা কঠোর গাম্ভীৰ্য তিষ্ঠিতে পারে না । গাহিয়া বাজাইয়া, আমোদ করিয়া চারি দিক পূর্ণ করিয়া রাখেন। চারি দিকে উল্লাস, সদ্ভাব, শান্তি । সেইখানে গেলেই আমি ভুলিয়া যাইতাম যে, আমি যশোহরের যুবরাজ । সে কী আরামের ভুল ! অবশেষে আমার বয়স যখন আঠারো বৎসর, একদিন রায়গড়ে বসন্তের বাতাস বহিতেছিল, চারি দিকে সবুজ কুঞ্জবন, সেই বসন্তে আমি রুক্মিণীকে দেখিলাম ।” সুরমা বলিয়া উঠিল, “ও কথা অনেকবার শুনিয়াছি।” উদয়াদিত্য । আর-একবার শুন । মাঝে মাঝে এক-একটা কথা প্ৰাণের মধ্যে দংশন করিতে থাকে, সে কথাগুলো যদি বাহির করিয়া না দিই। তবে আর বঁাচিব কী করিয়া ? সেই কথাটা তোমার কাছে এখনো বলিতে লজা করে, কষ্ট হয়, তাই বার বার করিয়া বলি । যেদিন আর লজা করিবে না, কষ্ট হইবে না, সেদিন বুঝিব আমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হইল, সেদিন আর বলিব না । সুরমা । কিসের প্রায়শ্চিত্ত প্ৰিয়তম ? তুমি যদি পাপ করিয়া থাক তো সে পাপের দোষ, তোমার দোষ নহে । আমি কি তোমাকে জানি না ? অন্তর্যামী কি তোমার মন দেখিতে পান না ? উদয়াদিত্য বলিতে লাগিলেন, “রুক্সিণীর বয়স আমার অপেক্ষা তিন বৎসরের বড়ো । সে একাকিনী, বিধবা । দাদামহাশয়ের অনুগ্রহে সে রায়গড়ে বাস করিতে পাইত । মনে নাই, সে আমাকে কী কৌশলে প্ৰথমে আকর্ষণ করিয়া লইয়া গেল । তখন আমার মনের মধ্যে মধ্যাহ্নের কিরণ জ্বলিতেছিল। এত প্রখর আলো যে, কিছুই ভালো করিয়া দেখিতে পাইতেছিলাম না, চারি দিকে জগৎ জ্যোতির্ময় বাম্পে আবৃত । সমস্ত রক্ত যেন মাথায় উঠিতেছিল ; কিছুই আশ্চর্য, কিছুই অসম্ভব মনে হইত না ; পথ-বিপথ, দিক-বিদিক সমস্ত এক আকার ধারণ করিয়াছিল। ইহার পূর্বেও আমার এমন কখনো হয় নাই, ইহার পরেও আমার এমন কখনো হয় নাই । জগদীশ্বর জানেন, তাহার কী উদ্দেশ্য সাধন করিতে এই ক্ষুদ্র দুর্বল বুদ্ধিহীন হৃদয়ের বিরুদ্ধে এক দিনের জন্য সমস্ত জগৎকে যেন উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিলেন, বিশ্বচরাচর যেন একতন্ত্র হইয়া আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়টিকে মুহুর্তে বিপথে লইয়া গেল। মুহুর্তমাত্ৰ— আর অধিক নয়- সমস্ত বহির্জগতের মুহুর্তস্থায়ী এক নিদারুণ আঘাত, আর মুহুর্তের মধ্যে একটি ক্ষীণ হৃদয়ের মূল বিদীর্ণ হইয়া গেল, বিদ্যুদবেগে সে ধূলিকে আলিঙ্গন করিয়া পড়িল । তাহার পরে যখন উঠিল তখন ধূলিধূসরিত, স্নান- সে ধূলি আর মুছিল না, সে মলিনতার চিহ্ন আর উঠিল না। আমি কী করিয়াছিলাম বিধাতা, যে, পাপে এক মুহুর্তের মধ্যে আমার জীবনের