পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট や>> সুরমা কহিল, “আর কী হইবে ? মেহের বােধ করি আর কিছু অবশিষ্ট নাই। যেটুকু আছে সেটুকু গেলেও বড়ো একটা ক্ষতি হইবে না ।” বিভা কহিল, “না ভাই, আমার বড়ো ভয় করিতেছে । পিতা যদি কোনো প্রকার হানি করেন । যদি দণ্ড দেন ?” সুরমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “আমার বিশ্বাস, সংসারে যাহার কেহই সহায় নাই, নারায়ণ তাহার অধিক সহায় । হে প্ৰভু, তোমার নামে কলঙ্ক না হয় যেন । এ বিশ্বাস আমার ভাঙিয়ো না ।” দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ, কাজটা কি ভালো হইবে ?” মন্ত্রী কহিলেন, “কাল যাহা আদেশ করিয়াছিলেন ।” মন্ত্রী কহিলেন, “আপনার পিতৃব্য সম্বন্ধে।” প্রতাপাদিত্য আরো বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “আমার পিতৃব্য সম্বন্ধে কী ?” মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ আদেশ করিয়াছিলেন, যখন বসন্ত রায় যশোহরে আসিবার পথে শিমুলতলির চটিতে আশ্রয় লইবেন তখন—” প্রতাপাদিত্য ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া কহিলেন, “তখন কী ? কথাটা শেষ করিয়াই ফেলো ।” মন্ত্রী । তখন দুইজন পাঠান গিয়া— প্ৰতাপ । হা । মন্ত্রী । তাহাকে নিহত করিবে । প্রতাপাদিত্য রুষ্ট হইয়া কহিলেন, “মন্ত্রী, হঠাৎ তুমি শিশু হইয়াছ নাকি ? একটা কথা শুনিতে দশটা প্রশ্ন করিতে হয় কেন ? কথাটা মুখে আনিতে বুঝি সংকোচ হইতেছে! এখন বোধ করি তোমার রাজকার্যে মনোযোগ দিবার বয়স গিয়াছে, এখন পরকাল চিন্তার সময় আসিয়াছে । এতদিন অবসর প্রার্থনা করা নাই কেন ?” মন্ত্রী । মহারাজ আমার ভাবটা ভালো বুঝিতে পারেন নাই । প্ৰতাপ । বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়াছি । কিন্তু একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি যে কাজটা করিতে পারি, তুমি তাহা মুখে আনিতেও পার না ? তোমার বিবেচনা করা উচিত ছিল, আমি যখন এ কাজটা করিতে যাইতেছি, তখন অবশ্য তাহার গুরুতর কারণ আছে ; আমি অবশ্য ধর্ম অধৰ্ম সমস্ত ভাবিয়ছিলাম । মন্ত্রী ; আজ্ঞা মহারাজ, আমি— প্রতাপ । চুপ করো, আমার সমস্ত কথাটা শোনো আগে । আমি যখন এ কাজটা— আমি যখন নিজের পিতৃব্যকে খুন করিতে উদ্যত হইয়াছি, তখন অবশ্য তোমার চেয়ে ঢের বেশি ভাবিয়ছি। এ কাজে অধৰ্ম নাই । আমার ব্ৰত এই— এই যে স্নেচ্ছের আমাদের দেশে আসিয়া অনাচার আরম্ভ করিয়াছে, যাহাদের অত্যাচারে আমাদের দেশা হইতে সনাতন আর্যধর্ম লোপ পাইবার উপক্রম হইয়াছে, ক্ষত্ৰিয়েরা মোগলকে কন্যা দিতেছে, হিন্দুরা আচারভ্ৰষ্ট হইতেছে, এই স্নেচ্ছদের আমি দূর করিয়া দিব, আমাদের আর্যধর্মকে রাহুর গ্রাস হইতে মুক্ত করিব । এই ব্ৰত সাধন করিতে অনেক বলের আবশ্যক । আমি চাই, সমস্ত বঙ্গদেশের রাজারা আমার অধীনে এক হয় ; যাহারা যবনের মিত্র, তাহাদের বিনাশ না করিলে ইহা সিদ্ধ হইবে না । পিতৃব্য বসন্ত রায় আমার পূজ্যপাদ, কিন্তু যথার্থ কথা বলিতে পাপ নাই, তিনি আমাদের বংশের কলঙ্ক । তিনি আপনাকে স্নেচ্ছের দাস বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, এমন লোকের সহিত প্রতাপাদিত্য রায়ের কোনো সম্পর্ক নাই । ক্ষত হইলে নিজের বাহুকে কাটিয়া ফেলা