পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট と > (? উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমাকে বাধা দিয়ে না । আমি রাজবাটীর কর্মচারী । দুইজন অপরাধীর এই কথা বলিয়াই তিনি প্ৰবেশ করিলেন । চাটি-রক্ষক তাহাকে আর বাধা দিল না । তিনি সমস্ত অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন । না বসন্ত রায়, না তাহার অনুচর, না কোনো পাঠানকে দেখিতে পাইলেন । কেবল দুইজন সুপ্তোখিত প্রৌঢ়া চেচাইয়া উঠিল, “আ মরণ, মিনসে আমন করিয়া তাকাইতেছিস কেন ?” চটি হইতে বাহির হইয়া পথে দাড়াইয়া যুবরাজ ভাবিতে লাগিলেন । একবার মনে করিলেন যে, ভালোই হইয়াছে, হয়তো আজি দৈবক্রমে তিনি আসিতে পারেন নাই । আবার মনে করিলেন, যদি ইহার পর্ববর্তী কোনো চটিতে থাকেন ও পাঠানেরা তাহার অনুসন্ধানে সেখানে গিয়া থাকে ? এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেই পথ বাহিয়া চলিতে লাগিলেন । কিয়দর গিয়া দেখিলেন, বিপরীত দিক হইতে একজন অশ্বারোহী আসিতেছে । নিকটে আসিলে কহিলেন, “ কে ও, রতন নাকি ?” সে অশ্ব হইতে তৎক্ষণাৎ নামিয়া তাহাকে প্ৰণাম করিয়া কহিল, “আজ্ঞা হা । যুবরাজ, আপনি এত রাত্রে এখানে যে ?” যুবরাজ কহিলেন, “ তাহার কারণ পরে বলিব । এখন বলে তো দাদামহাশয় কোথায় আছেন ।” “আজ্ঞা, তাহার তো চটিতেই থাকিবার কথা ।” “ সে কী ! সেখানে তো তাহাকে দেখিলাম না ।” সে অবাক হইয়া কহিল, “ত্রিশজন অনুচরসমেত মহারাজ যশোর উদ্দেশে যাত্ৰা করিয়াছেন । আমি কাৰ্যবশত পিছাইয়া পড়িয়ছিলাম । এই চটিতে আজি সন্ধ্যাবেলা তাহার সহিত মিলিবার কথা ।” “পথে যেরূপ কাদা তাহাতে পদচিহ্ন থাকিবার কথা, তাহাই অনুসরণ করিয়া আমি তাহার অনুসন্ধানে চলিলাম । তোমার ঘোটক লইলাম । তুমি পদব্রজে আইস ।” চতুর্থ পরিচ্ছেদ বিজন পথের ধারে অশথ গাছের তলায় বাহক শূন্য ভূতলস্থিত এক শিবিকার মধ্যে বৃদ্ধ বসন্ত রায় বসিয়া আছেন । কাছে আর কেহ নাই, কেবল একটি পাঠান শিবিকার বাহিরে । একটা জনকোলাহল দূরে মিলাইয়া গেল । রজনী স্তব্ধ হইয়া গেল । বসন্ত রায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “খা সাহেব, তুমি যে গেলে না ?” পাঠান কহিল, “হুজুর, কী করিয়া যাইব ? আপনি আমাদের ধনপ্রাণ রক্ষার জন্য আপনার সকল অনুচরগুলিকেই পাঠাইলেন । আপনাকে এই পথের ধারে রাত্রে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া যাইব, এতবড়ো অকৃতজ্ঞ আমাকে ঠাহরাইবেন না। আমাদের কবি বলেন, যে আমার অপকার করে সে আমার কাছে ঋণী ; পরকালে সে ঋণ তাহাকে শোধ করিতে হইবে ; যে আমার উপকার করে আমি তাহার কাছে ঋণী, কিন্তু কোনোকালে তাহার সে ঋণ শোধ করিতে পারিব না ।” বসন্ত রায় মনে মনে কহিলেন, বাহবা, লোকটা তো বড়ো ভালো। কিছুক্ষণ বিতর্ক করিয়া পালকি হইতে তাহার টাকবিশিষ্ট মাথাটি বাহির করিয়া কহিলেন, “খা সাহেব, তুমি বড়ো ভালো লোক ৷” খ্যা সাহেব তৎক্ষণাৎ এক সেলাম করিলেন । এ বিষয়ে বসন্ত রায়ের সহিত খ্যা সাহেবের কিছুমাত্র মতের অনৈক্য ছিল না । বসন্ত রায় মশালের আলোকে তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন, ”তোমাকে বড়োঘরের লোক বলিয়া মনে হইতেছে।” পাঠান আবার সেলাম করিয়া কহিল, “কেয়া তাজব, মহারাজ, ঠিক ঠাহরাইয়াছেন।” বসন্ত রায় কহিলেন, “এখন তোমার কী করা হয় ?” পাঠান নিশ্বাস ছাড়িয়া কহিল, “হুজুর, দুরবস্থায় পড়িয়াছি, এখন চাষবাস করিয়া গুজরান চালাইতে হইতেছে। কবি বলিতেছেন, হে অদৃষ্ট, তুমি যে তৃণকে তৃণ করিয়া গড়িয়াছ, ইহাতে তোমার নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায় না, কিন্তু তুমি যে অশথ গাছকে অশথ গাছ করিয়া গড়িয়া অবশেষে ঝড়ের হাতে তাহাকে