পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VSA যতগুলি গলা দিয়াছেন তাহার একটি-না-একটি শ্রোতা আছেই। আমার গলাও ভালো লাগে এমন দুটাে অর্বািচীন আছে। নইলে এতদিনে সাহেব, এ গলার দােকানপাট বন্ধ করিতাম ; সেই দুটাে আনাড়ি খরিদার আছে, মাল চিনে না, তাহাদেরই কাছ হইতে বাহবা মিলে। অনেকদিন দুটাকে দেখি নাই, গীতগানও বন্ধ আছে ; তাই ছুটিয়া চলিয়াছি। মনের সাধে গান শুনাইয়া, প্ৰাণের বোঝা নামাইয়া বাড়ি ফিরিব।” বৃদ্ধের ক্ষীণজ্যোতি চােখদুটি স্নেহে ও আনন্দে দীপ্যমান হইয়া উঠিল । পাঠান মনে মনে কহিল, তোমার একটা সাধ মিটিয়াছে, গান শুনানো হইয়াছে, এখন প্ৰাণের বোঝাটা আমিই নামাইব কি ? তোবা, তোবা, এমন কাজও করে ! কাফেরকে মারিলে পুণ্য আছে বটে কিন্তু সে পুণ্য এত উপার্জন করিয়াছি যে পরকালের বিষয়ে আর বড়ো ভাবনা নাই, কিন্তু ইহকালের সমস্তই যে-প্রকার বেবন্দোবস্ত দেখিতেছি, তাহাতে এই কাফেরটাকে না মারিয়া যদি তাহার একটা বিলিবন্দোজ করিয়া লইতে পারি। তাহাতে আপত্তি দেখিতেছি না । বসন্ত রায় কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া আর থাকিতে পারিলেন না, তাহার কল্পনা উত্তেজিত হইয়া উঠিল— পাঠানের নিকটবতী হইয়া অতি চুপি চুপি কহিলেন, “কাহাদের কথা বলিতেছিলাম, সাহেব, জান ? তাহারা আমার নাতি ও নাতনী ।” বলিতে বলিতে অধীর হইয়া উঠিলেন, ভাবিলেন- আমার অনুচরেরা কখন ফিরিয়া আসিবে ? আবার সেতার লইয়া গান আরম্ভ করিলেন । একজন অশ্বারোহী পুরুষ নিকটে আসিয়া কহিল, “আঃ র্বাচিলাম। দাদামহাশয় পথের ধারে এত রাত্রে কাহাকে গান শুনাইতেছ ?” আনন্দে ও বিস্ময়ে বসন্ত রায় তৎক্ষণাৎ তাহার সেতার শিবিকা-উপরে রাখিয়া উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া নামাইলেন ও তাঁহাকে দৃঢ়রাপে আলিঙ্গন করিলেন । জিজ্ঞাসা করিলেন, “খবর কী দাদা ? দিদি। ভালো আছে তো ?” তখন বৃদ্ধ হাসিতে হাসিতে সেতার তুলিয়া লইলেন ও পা দিয়া তাল রাখিয়া মাথা নাড়িয়া গান “বঁধুয়া অসময়ে কেন হে প্ৰকাশ ? সকলি যে স্বপ্ন বলে হতেছে বিশ্বাস । চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে ছিলে, সেথায় তো আদর মিলে ? এরি মধ্যে মিটিল। কি প্ৰণয়েরি। আশা ? এখনো তো রয়েছে রাত, এখনো তো হয় নি প্রভাত, এখনো এ রাধিকার ফুরায় নি তো অশ্রুপাত । চন্দ্রাবলীর কুসুমসাজ এখনি কি শুকাল আজ ? চকোর হে, মিলাল কি সে চন্দ্ৰমুখের মধুর হাস ?” উদয়াদিত্য পাঠানের দিকে চাহিয়া বসন্ত রায়কে কানে কানে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদামহাশয়, এ কাবুলি কোথা হইতে জুটিল ?” উদয়াদিত্যকে দেখিয়া খা সাহেব মনে মনে বিশেষ চঞ্চল হইয়া পড়িয়াছিল, কী করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না । উদয়াদিত্য পিতামহকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “চটিতে না গিয়া এখানে যে ?” পাঠান সহসা বলিয়া উঠিল, “হুজুর, আশ্বাস পাই তো একটা কথা বলি। আমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রজা । মহারাজ আমাকে ও আমার ভাইকে আদেশ করেন যে আপনি যখন যশোরের মুখে আসিবেন, তখন পথে আপনাকে খুন করা হয় ।”