পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট V NR NS হইয়া আসিয়াছে, এখনো যে কেন ডাক পড়িল না বিধাতা জানেন । কিন্তু আর অধিক বিলম্ব নাই ।” বসন্ত রায় কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, প্রতাপাদিত্য কোনো উত্তর করিলেন না । বসন্ত রায় আবার কহিলেন, “তবে স্পষ্ট করিয়া সমস্ত বলি। তুমি যে আমাকে ছুরি তুলিয়াছ, তাহাতে আমাকে ছুরির অপেক্ষা অধিক বাজিয়াছে। (বলিতে বলিতে তাহার চক্ষে জল আসিল।) কিন্তু আমি কিছুমাত্র রাগ করি নাই। আমি কেবল তোমাকে দুটি কথা বলিব । আমাকে বধ করিয়ো না প্ৰতাপ ! তাহাতে তোমার ইহকাল পরকালের ভালো হইবে না। এতদিন পর্যন্ত যদি আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিতে পারিলে, তবে আর দুটা দিন পরিবে না ? এইটুকুর জন্য পাপের ভাগী হইবে ?” বসন্ত রায় দেখিলেন, প্রতাপাদিত্য কোনো উত্তর দিলেন না । দোষ অস্বীকার করিলেন না, বা অনুতাপের কথা কহিলেন না । তৎক্ষণাৎ তিনি অন্য কথা পাড়িলেন, কহিলেন, “প্ৰতাপ, একবার রায়গড়ে চলো । অনেকদিন সেখানে যাও নাই। অনেক পরিবর্তন দেখিবে । সৈন্যেরা এখন তলোয়ার ছাডিয়া লাঙল ধরিয়াছে ; যেখানে সৈন্যদের বাসস্থান ছিল সেখানে অতিথিশালা-” এমন সময়ে প্রতাপাদিত্য দূর হইতে দেখিলেন, পাঠানটা পালাইবার উদযোগ করিতেছে। আর থাকিতে পারিলেন না । মনের মধ্যে যে নিরুদ্ধ রোষ ফুটিতেছিল, তাহা অগ্নি-উৎসের ন্যায় উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । বৰ্জস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “খবরদার উহাকে ছাড়িস না । পাকড়া করিয়া রাখা।” বলিয়া ঘর হইতে দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেলেন । মন্ত্রী আস্তে আস্তে কহিলেন, “মহারাজ, এ বিষয়ে আমার কোনো দোষ নাই ।” প্রতাপাদিত্য তারস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “আমি কি কোনো বিষয়ের উল্লেখ করিতেছি ? আমি বলিতেছি, রাজকার্যে তোমার অত্যন্ত অমনোযোগ লক্ষিত হইতেছে । সেদিন তোমার কাছে এক চিঠি দেড় মাস পূর্বে এইরূপ একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল বটে, কিন্তু তখন মহারাজ মন্ত্রীকে একটি কথাও বলেন নাই । “আর-একদিন উমেশ রায়ের নিকট তোমাকে যাইতে আদেশ করিলাম, তুমি লোক পঠাইয়া কাজ সারিলে। চুপ করো। দোষ কটাইবার জন্য মিছামিছি চেষ্টা করিয়ো না । যাহা হউক তোমাকে জানাইয়া রাখিলাম, রাজকার্যে তুমি কিছুমাত্ৰ মনোযোগ দিতেছ। না ।” রাজা প্রহরীদের ডাকাইলেন। পূর্বে রাত্রের প্রহরীদের বেতন কাটিয়াছিলেন, এখন তাহাদের প্রতি কারাবাসের আদেশ হইল । অন্তঃপুরে গিয়া মহিষীকে ডাকাইয়া কহিলেন, “মহিষী, রাজপরিবারের মধ্যে অত্যন্ত বিশৃঙ্খলা দেখিতেছি। উদয়াদিত্য পূর্বে তো এমন ছিল না। এখন সে যখন-তখন বাহির হইয়া যায়। প্রজাদের কাজে যোগ দেয় । আমার বিরুদ্ধাচরণ করে । এ সকলের অর্থ কী ?” মহিষী ভীত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ, তাহার কোনো দোষ নাই। এ সমস্ত অনার্থের মূল ঐ বড়োবাউ । বাছা আমার তো আগে এমন ছিল না । যেদিন হইতে শ্ৰীপুরের ঘরে তাহার বিয়ে হইল, সেই দিন হইতে উদয় কেমন যে হইল কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।” মহারাজ সুরমাকে শাসনে রাখিতে আদেশ করিয়া বাহিরে গেলেন। মহিষী উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন । উদয়াদিত্য আসিলে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আহা, বাছা আমার রোগা কালো হইয়া গিয়াছে। বিয়ের আগে বাছার রঙ কেমন ছিল । যেন তপ্ত সোনার মতো । তোর এমন দশা কে করিল ? বাবা, বড়োবাউ তোকে যা বলে তা শুনিস না । তার কথা শুনিয়াই তোর এমন দশা হইয়াছে।” সুরমা ঘোমটা দিয়া চুপ করিয়া একপাশে দাড়াইয়া ছিল। মহিষী বলিতে লাগিলেন, “ওর ছোটো বংশে জন্ম, ও কি তোর যোগ্য ? ও কি তোকে পরামর্শ দিতে জানে ? আমি যথাৰ্থ কথা বলিতেছি ও কখনো তোকে ভালো পরামর্শ দেয় না, তোর মন্দ হইলেই ও যেন বঁাচে । এমন রাক্ষসীর সঙ্গেও মহারাজ তোর বিবাহ দিয়াছিলেন ।” মহিষী অশ্রুবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন ।