পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট V) SG সুরমা কহিল, “বৎসরের মধ্যে একটি দিন ঠাকুরজামাইকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া পাঠাইতেও কাহারও মনে পড়ে না ।” বসন্ত রায় চিন্তা করিয়া কহিলেন, “ঠিক কথাই তো ।” সুরমা কহিল, “স্বামীর প্রতি এ অনাদর কয়জন মেয়ে সহিতে পারে বলে তো ? বিভা ভালোমানুষ, তাই কাহাকেও কিছু বলে না, আপনার মনে লুকাইয়া কঁদে ।” বসন্ত রায় ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “আপনার মনে লুকাইয়া কঁদে ?” সুরমা । আজ বিকেলে আমার কাছে কত কঁাদিতেছিল। বসন্ত রায় । বিভা আজ বিকালে কঁদিতেছিল ? সুরমা । হাঁ । বসন্ত রায় । আহা, তাহাকে একবার ডাকিয়া আনো, আমি দেখি । সুরমা বিভাকে ধরিয়া আনিল । বসন্ত রায় তাহার চিবুক ধরিয়া কহিলেন, “তুই কঁদিস কেন দিদি ? যখন তোর যা কষ্ট হয় তোর দাদামহাশয়কে বলিস না কেন ? তা হলে আমি আমার যথাসাধ্যা করি । আমি এখনই যাই, প্ৰতাপকে বলিয়া আসি গো ।” বিভা বলিয়া উঠিল, “দাদামহাশয়, তোমার দুটি পায়ে পড়ি আমার বিষয়ে বাবাকে কিছু বলিয়ে না । দাদামহাশয়, তোমার পায়ে পড়ি, যাইয়ো না ।” জামাতাকে অনেকদিন নিমন্ত্রণ করা নাই, ইহাতে তাহার প্রতি নিতান্ত অবহেলা প্ৰকাশ করা হইতেছে । যশোহরপতির জামাতাকে যতখানি সমাদর করা উচিত, ততখানি সমাদর যদি তাহাকে না করা হয়, তবে তাহাতে তোমারই অপমান । তাহাতে গৌরবের কথা কিছুই নাই ।” প্রতাপাদিত্য পিতৃব্যের কথায় কিছুমাত্র দ্বিরুক্তি করিলেন না । লোকসহ নিমন্ত্রণপত্ৰ চন্দ্ৰদ্বীপে পাঠাইবার হুকুম হইল । অন্তঃপুরে বিভা ও সুরমার কাছে আসিয়া বসন্ত রায়ের সেতার বাজাইবার ধুম পড়িয়া গেল । “মলিন মুখে ফুটুক হাসি জুড়াক দু-নয়ন ৷” বিভা লজিত হইয়া কহিল, “দাদামহাশয়, বাবার কাছে আমার কথা সমস্ত বলিয়াছ ?” বসন্ত রায় গান গাহিতে লাগিলেন, “মলিন মুখে ফুটুক হাসি, জুড়াক দু-নয়ন । মলিন বসন ছাড়ো সখী, পরো আভরণ ।” বড় সেতারের তার হাত দিয়া সেতার বন্ধ করিয়া আবার কােল, “বাবার কাছে আমার কথা p” এমন সময়ে উদয়াদিত্যের কনিষ্ঠ অষ্টমন্বষীয় সমর্যাদিত্য ঘরের মধ্যে উকি মারিয়া বলিয়া উঠিল, ”আঁ্যা দিদি । দাদামহাশয়ের সহিত গল্প করিতেছ! আমি মাকে বলিয়া দিয়া আসিতেছি।” “এসো, এসো, ভাই এসো ।” বলিয়া বসন্ত রায় তাহাকে পাকড়া করিলেন । রাজপরিবারের বিশ্বাস এই যে, বসন্ত রায় ও সুরমায় মিলিয়া উদয়াদিত্যের সর্বনাশ করিয়াছে। এই নিমিত্ত বসন্ত রায় আসিলে সামাল সামাল পড়িয়া যায় । সমর্যাদিত্য বসন্ত রায়ের হাত ছাড়াইবার জন্য টানাহেঁচড়া আরম্ভ করিল । বসন্ত রায় তাহাকে সেতার দিয়া, তাহাকে কঁধে চড়াইয়া, তাহাকে চশমা পরাইয়া, দুই দণ্ডের মধ্যে এমনি বশ করিয়া লইলেন যে, সে সমস্ত দিন দাদামহাশয়ের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ফিরিতে লাগিল ও অনবরত সেতার বাজাইয়া তাহার সেতারের পাচটা তার ছিড়িয়া দিল ও মেজরাপ কাড়িয়া লইয়া আর দিল না । S8O