পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট W RS কাঁৱাইবেন, তবে তাহার নাম রাজা রামচন্দ্র রায় । এতবড়ো মহৎ কাজটা যদি তিনি না করিতে পারিলেন তবে আর তিনি কিসের রাজা । চন্দ্ৰদ্বীপাধিপতি রামমোহন মালকে ডাকিয়া পাঠাইলেন । রামমোহন মাল পরাক্রমে ভীমের মতো ছিল । শরীর প্রায় সাড়ে চারিহাত লম্বা । সমস্ত শরীরে মাংসপেশী তরঙ্গিত । সে স্বগীয় রাজার আমলের লোক । রামচন্দ্ৰকে বাল্যকাল হইতে পালন করিয়াছে। রমাইকে সকলেই ভয় করে, রমাই যদি কাহাকেও ভয় করে তো সে এই রামমোহন । রামমোহন রমাইকে অত্যন্ত ঘূণা করিত । রামাই তাহার ঘূণার দৃষ্টিতে কেমন আপনা-আপনি সংকুচিত হইয়া পড়িত । রামমোহনের দৃষ্টি এড়াইতে পরিলে সে ছাড়িত না । রামমোহন আসিয়া দাড়াইল । রাজা কহিলেন, তাহার সঙ্গে পঞ্চাশজন অনুচর যাইবে । রামমোহন তাহাদিগের সর্দার হইয়া যাইবে । রামমোহন কহিল, “ যে আজ্ঞা । রামাই ঠাকুর যাইবেন কি ?” বিড়ালচক্ষু খর্বাকৃতি রামাই ঠাকুর সংকুচিত হইয়া পড়িল । অষ্টম পরিচ্ছেদ যশোহর রাজবাটীতে আজ কর্মচারীরা ভারি ব্যস্ত। জামাতা আসিবে, নানাপ্রকার উদযোগ করিতে হইতেছে । আহারাদির বিস্তৃত আয়োজন হইতেছে। চন্দ্ৰদ্বীপের রাজবংশ যশোহরের তুলনায় যে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর, সে বিষয়ে প্রতাপাদিত্যের সহিত মহিষীর কোনো মতান্তর ছিল না, তথাপি জামাতা আসিবে বলিয়া আজ তাহার অত্যন্ত আহলাদ হইয়াছে ৷ প্ৰাতঃকাল হইতে বিভাকে তিনি স্বহস্তে সাজাইতে আরম্ভ করিয়াছেন— বিভা বিষম গোলযোগে পড়িয়াছে । কারণ, সাজাইবার পদ্ধতি সম্বন্ধে বয়স্ক মাতার সহিত যুবতী দুহিতার নানা বিষয়ে রুচিভেদ আছে ; কিন্তু হইলে হয় কী, বিভার কিসে ভালো হয়, মহিষী। তাহ অবশ্য ভালো বুঝেন । বিভার মনে মনে ধারণা ছিল তিনগাছি করিয়া পাতলা ফিরোজ রঙের চুড়ি পরিলে তাহার শুভ্ৰ কচি হাত দুইখানি বড়ো মানাইবে ; মহিষী তাহাকে সোনার আটগাছা মোটা চুড়ি ও হীরার এক-একগাছা বৃহদাকার বালা পরাইয়া এত অধিক আনন্দিত হইয়া উঠিলেন যে, সকলকে দেখাইবার জন্য বাড়ির সমুদয় বৃদ্ধ দাসী ও বিধবা পিসীদিগকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন । বিভা জানিত যে তাহার ছোটাে সুকুমার মুখখানিতে নাথ কোনোমতেই মানায় না- কিন্তু মহিষী তাহাকে একটা বড়ো নথ পরাইয়া তাহার মুখখানি একবার দক্ষিণ পার্শ্বে একবার বাম পার্শ্বে ফিরাইয়া গৰ্বসহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন । ইহাতেও বিভা চুপ করিয়া ছিল, কিন্তু মহিষী যে ছাদে তাহার চুল বাধিয়া দিলেন, তাহা তাহার একবারে অসহ্য হইয়া উঠিল । সে গোপনে সুরমার কাছে মনের মতো চুল র্বাধিয়া আসিল । কিন্তু তাহা মহিষীর নজর এড়াইতে পারিল না । মহিষী৷ দেখিলেন, কেবল চুল বাধার দোষে বিভার সমস্ত সাজ মাটি হইয়া গিয়াছে। তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, সুরমা হিংসা করিয়া বিভার চুল বাধা খারাপ করিয়া দিয়াছে। সুরমার হীন উদ্দেশ্যের প্রতি বিভার চোখ ফুটাইতে চেষ্টা করিলেন । অনেকক্ষণ বকিয়া যখন স্থির করিলেন কৃতকার্য হইয়াছেন তখন তাহার চুল খুলিয়া পুনরায় বাধিয়া দিলেন । এইরূপে বিভা তাহার খোপা, তাহার নাথ, তাহার দুই বাহুপূৰ্ণ চুড়ি, তাহার এক হৃদয়পূর্ণ আনন্দের ভার বহন করিয়া নিতান্ত বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। সে বুঝিতে পারিয়াছে যে, দুরন্ত আহলাদকে কোনোমতেই সে কেবলই অন্তঃপুরে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না, চােখে মুখে সে কেবলই বিদ্যুতের মতো উকি মারিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতেছে, বাড়ির দেওয়ালগুলা পর্যন্ত তাহাকে উপহাস করিতে উদ্যত রহিয়াছে । যুবরাজ উদয়াদিত্য আসিয়া গভীর স্নেহপূর্ণ প্রশান্ত আনন্দের সহিত বিভার সলজ্জ হর্ষপূৰ্ণ মুখখানি দেখিলেন। বিভার হর্ষ দেখিয়া তাহার এমনি আনন্দ হইল যে, গৃহে গিয়া সস্নেহে মৃদু হাস্যে সুরমাকে চুম্বন করিলেন । উদয়াদিত্য কহিলেন, “কিছুই না ।”