পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ\98 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রামচন্দ্র রায় শয্যায় শয়ন করিয়া অবধি বিভার সহিত একটি কথা কন নাই। প্রতাপাদিত্য র্তাহাকে অপমান করিয়াছে— তিনি প্রতাপাদিত্যকে অপমান করিবেন কী করিয়া ? না, বিভাকে অগ্রাহা করিয়া । তিনি জানাইতে চান, ‘তুমি তো যশোহরের প্রতাপাদিত্যের মেয়ে, চন্দ্ৰদ্বীপাধিপতি রাজা রামচন্দ্র রায়ের পাশে কি তোমাকে সাজে ?” এই স্থির করিয়া সেই যে পাশ ফিরিয়া শুইয়াছেন আর পার্শ্ব পরিবর্তন করেন নাই। যত মান-অভিমান সমস্তই বিভার প্রতি । বিভা জাগিয়া বসিয়া ভাবিতেছে। একবার জ্যোৎস্নার দিকে চাহিতেছে, একবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিতেছে। তাহার বুক কঁপিয়া কঁপিয়া এক-একবার দীর্ঘনিশ্বাস উঠিতেছে- প্ৰাণের মধ্যে বড়ো ব্যথা বাজিয়াছে। সহসা একবার রামচন্দ্রের ঘুম ভাঙিয়া গেল । সহসা দেখিলেন, বিভা চুপ করিয়া বসিয়া কঁদিতেছে। সেই নিদ্রোখিত অবস্থার প্রথম মুহুর্তে যখন অপমানের স্মৃতি জাগিয়া উঠে নাই, গভীর নিদ্রার পরে মনের সুস্থ ভাব ফিরিয়া আসিয়াছে, রোষের ভােব চলিয়া গিয়াছে, তখন সহসা বিভার সেই অশ্রুশ্লিাবিত করুণ কচি মুখখানি দেখিয়া সহসা তার মনে করুণা জাগিয়া উঠিল। বিভার হাত ধরিয়া কহিলেন, “বিভা, কঁদিতেছ ?” বিভা আকুল হইয়া উঠিল । বিভা কথা কহিতে পারিল না, বিভা চােখে দেখিতে পাইল না, বিভা শুইয়া পড়িল । তখন রামচন্দ্র রায় উঠিয়া বসিয়া ধীরে ধীরে বিভার মাথাটি লইয়া কোলের উপর রাখিলেন, তাহার অশ্রুজল মুছাইয়া দিলেন । এমন সময়ে দ্বারে কে আঘাত করিল। রামচন্দ্ৰ বলিয়া উঠিলেন, “ কে ও ?” বাহির হইতে উত্তর আসিল, “অবিলম্বে দ্বার খোলো ।” দশম পরিচ্ছেদ রামচন্দ্র রায় শয়নকক্ষের দ্বার উদঘাটন করিয়া বাহিরে আসিলেন । রাজশ্যালক রমাপতি কহিলেন, “বাবা, এখনই পালাও, মুহূর্ত বিলম্ব করিয়ো না ।” সেই রাত্রে সহসা এই কথা শুনিয়া রামচন্দ্র রায় একেবারে চমকিয়া উঠিলেন, তাহার মুখ সাদা হইয়া গেল, রুদ্ধ নিশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, কেন, কী হইয়াছে ?” “কী হইয়াছে তাহা বলিব না, এখনই পালাও ।” রমাপতি কহিলেন, “ সে কথা তোমার শুনিয়া কাজ নাই, মা ।” বিভার প্রাণ র্কাদিয়া উঠিল । সে একবার বসন্ত রায়ের কথা ভাবিল, একবার উদয়াদিত্যের কথা রমাপতি তাহার কথার কোনো উত্তর না দিয়া রামচন্দ্ৰকে কহিলেন, “বাবা, অনৰ্থক কালবিলম্ব হইতেছে । এই বেলা গোপনে পলাইবার উপায় দেখো ।” হঠাৎ বিভার মনে একটা দারুণ অশুভ আশঙ্কা জাগিয়া উঠিল । গমনোদ্যত মাতুলের পথরোধ করিয়া কহিল, “ওগো তোমার দুটি পায়ে পড়ি, কী হইয়াছে বলিয়া যাও।” মুক্তি সভায় চার দিকে চাহিয়া কছিলেন, “গােল কািরস নে বিভা, চুপ কর, আমি সমস্তই তেছি ।” যখন রমাপতি একে একে সমস্তটা বলিলেন, তখন বিভা একেবারে চীৎকার করিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিল। রমাপতি তাড়াতাড়ি তাহার মুখ চাপিয়া ধরিলেন— কহিলেন, “চুপ, চুপ, সর্বনাশ করিস নে ৷” বিভা রুদ্ধশ্বাসে অর্ধরুদ্ধস্বরে সেইখানে বসিয়া পড়িল । রামচন্দ্র রায় সকাতরে কহিলেন, “এখন আমি কী উপায় করিব ? পলাইবার কী পথ আছে, আমি তো কিছুই জানি না।” রমাপতি কহিলেন, “আজ রাত্রে প্রহরীরা চারি দিকে সতর্ক আছে । আমি একবার চারি দিকে দেখিয়া আসি যদি কোথাও কোনো উপায় থাকে ৷”