পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\Oby রবীন্দ্র-রচনাবলী আরো দৃঢ় হইবে । আজ রাত্রেই কোনোমতে প্রাসাদ হইতে পলাইবার উপায় করিয়া দাও।” উদয়াদিত্য চিন্তিতভাবে কিয়ৎক্ষণ সুরমার মুখের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তবে আমি যাই, বলপ্রয়োগ করিয়া দেখি গে৷ ” সুরমা দৃঢ়ভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “যাও ।” উদয়াদিত্য র্তাহার উত্তরীয় বসন ফেলিয়া দিলেন, চলিলেন । সুরমা সঙ্গে সঙ্গে কিছুদূর গেল । নিভৃত স্থানে গিয়া সে উদয়াদিত্যের বক্ষ আলিঙ্গন করিয়া ধরিল উদয়াদিত্য শিরা নত করিয়া তাহাকে একটি দীর্ঘ চুম্বন করিলেন ও মুহুর্তের মধ্যে চলিয়া গেলেন । তখন সুরমা তাহার শয়নকক্ষে আসিয়া উপস্থিত হইল । তাহার দুই চোখ বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল । জোড়হন্তে কহিল, “মাগো, যদি আমি পতিব্ৰতা সতী হই, তবে এবার আমার স্বামীকে তাহার পিতার হাত হইতে রক্ষা করে । আমি যে তাহাকে আজ এই বিপদের মধ্যে বিদায় দিলাম, সে কেবল তোর ভরসাতেই মা । তুই যদি আমাকে বিনাশ করিস, তবে পৃথিবীতে তোকে আর কেহ বিশ্বাস করিবে না।” বলিতে বলিতে কঁাদিয়া উঠিল । সুরমা সেই অন্ধকারে বসিয়া কতবার মনে মনে “মা” “মা”। বলিয়া ডাকিল, কিন্তু মনে হইল যেন ম৷ তাহার কথা শুনিতে পাইলেন না । মনে মনে তাহার পায়ে যে পুষ্পাঞ্জলি দিল মনে হইল যেন তিনি তাহা লইলেন না, তাহার পা হইতে পড়িয়া গেল । সুরমা কঁাদিয়া কহিল, “কেন মা, আমি কী করিয়াছি ?” তাহার উত্তর শুনিতে পাইল না । সে সেই চারি দিকের অন্ধকারের মধ্যে দেখিতে পাইল, প্ৰলয়ের মূর্তি নাচিতেছে । সুরমা চারি দিক শূন্যময় দেখিতে লাগিল । সে একাকী সে-ঘরে আর বসিয়া থাকিতে পারিল না । বাহির হইয়া বিভার ঘরে আসিল । বসন্ত রায় কাতর স্বরে কহিলেন, “দাদা এখনো ফিরিল না, কী হইবে ?” সুরমা দেয়ালে ঠেস দিয়া দাড়াইয়া কহিল, “বিধাতা যাহা করেন ।” রামচন্দ্র রায় তখন মনে মনে তাহার পুরাতন ভূত্য রামমোহনের সর্বনাশ করিতেছিলেন । কেননা, তাহা হইতেই এই-সমস্ত বিপদ ঘটিল । তাহার যতপ্রকার শাস্তি সম্ভব তাহার বিধান করিতে ছিলেন । মাঝে মাঝে এক-একবার চৈতন্য হইতেছে যে, শাস্তি দিবার বুঝি আর অবসর থাকিবে না । উদয়াদিত্য তরবারি হস্তে অন্তঃপুর অতিক্ৰম করিয়া রুদ্ধ দ্বারে গিয়া সবলে পদাঘাত করিলেন— কহিলেন, “ কে আছিস ?” যুবরাজ দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “শীঘ্ৰ দ্বার খোলো ।” সে অবিলম্বে দ্বার খুলিয়া দিল । উদয়াদিত্য চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিলে সে জোড়হস্তে কহিল, “যুবরাজ মাপ করুন, আজ রাত্রে অন্তঃপুর হইতে কাহারও বাহির হইবার হুকুম নাই ।” যুবরাজ কহিল, “সীতারাম, তবে কি তুমিও আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিবে ? আচ্ছা, তবে এসো ।” বলিয়া আসি নিষ্কাশিত করিলেন । সীতারাম জোড়হন্তে কহিল, “না যুবরাজ, আপনার বিরুদ্ধে অস্ত্ৰধারণ করিতে পারিব না, আপনি দুইবার আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন।” বলিয়া তাহার পায়ের ধুলা মাথায় তুলিয়া লইল । যুবরাজ কহিলেন, “তবে কী করিতে চাও শীঘ্ৰ করো, আর সময় নাই।” সীতারাম কহিল, “যে প্ৰাণ আপনি দুইবার রক্ষা করিয়াছেন, এবার তাহাকে বিনাশ করিবেন না । আমাকে নিরস্ত্র করুন । এই লাউন আমার অস্ত্র । আমাকে আপাদমস্তক বন্ধন করুন । নহিলে যুবরাজ তাহার অস্ত্ৰ লইলেন, তাহার কাপড় দিয়া তাহাকে বাধিয়া ফেলিলেন । সে সেইখানে পড়িয়া রহিল, তিনি চলিয়া গেলেন । কিছুদূর গিয়া একটা অনতিউচ্চ প্রাচীরের মতো আছে সে প্রাচীরের একটিমাত্র দ্বার, সে দ্বারও রুদ্ধ। সেই দ্বার অতিক্রম করিলেই একেবারে অন্তঃপুরের বাহিরে যাওয়া যায়। যুবরাজ দ্বারে আঘাত না করিয়া একেবারে প্রাচীরের উপর লাফ দিয়া উঠিলেন । দেখিলেন, একজন প্রহরী প্রাচীরে ঠেসান দিয়া দিব্য আরামে নিদ্ৰা যাইতেছে । অতি সাবধানে তিনি