পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VV), নামিয়া পড়িলেন । বিদ্যুদবেগে সেই নিদ্রিত প্রহরীর উপর গিয়া পড়িলেন। তাহার অস্ত্ৰ কাড়িয়া দূরে ফেলিয়া দিলেন ও সেই হতবুদ্ধি অভিভূত প্রহরীকে আপাদমস্তক বাধিয়া ফেলিলেন । তাহার কাছে চাবি ছিল, সেই চাবি কাড়িয়া লইয়া দ্বার খুলিলেন । তখন প্রহরীর চৈতন্য হইল, বিস্মিত স্বরে কহিল, যুবরাজ কহিলেন, “অন্তঃপুরের দ্বার খুলিতেছি।” প্রহরী কহিল, “কাল মহারাজের কাছে কী জবাব দিব ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “বলিস, যুবরাজ বলপূর্বক আমাদিগকে পরাভূত করিয়া অন্তঃপুরের দ্বার খুলিয়াছেন । তাহা হইলে খালাস পাইবি ।” উদয়াদিত্য অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া যে-ঘরে জামাতার লোকজন থাকে সেইখানে উপস্থিত হইলেন । সে-ঘরে কেবল রামমোহন ও রামাই ভীড় ঘুমাইতেছিল, আর বাকি সকলে আহারাদি করিয়া নৌকায় গিয়াছে। যুবরাজ ধীরে ধীরে রামমোহনকে স্পর্শ করিলেন । সে চমকিয়া লাফাইয়া উঠিল । বিস্মিত হইয়া কহিল, “এ কী ? যুবরাজ ?” যুবরাজ কহিলেন, “বাহিরে এসো ।” রামমোহন বাহিরে আসিল । রামমোহনকে যুবরাজ সমস্ত কহিলেন । তখন রামমোহন মাথায় চাদর বাধিয়া লাঠি বাগাইয়া ধরিল, ক্ৰোধে স্ফীত হইয়া কহিল, “ দেখিব দিন । আমি একা এই লাঠি লইয়া একশো জন লোক ভাগাইতে পারি !” যুবরাজ কহিলেন, “ সে কথা আমি মানি, কিন্তু যশোহরের রাজপ্রাসাদে এক শত অপেক্ষা অনেক অধিক লোক আছে। তুমি বলপূর্বক কিছু করিতে পরিবে না । অন্য কোনো উপায় দেখিতে হইবে।” আমি নিশ্চিন্ত হইয়া উপায় ভাবিতে পারি।” তখন অন্তঃপুরে গিয়া উদয়াদিত্য রামচন্দ্ৰকে আহবান করিলেন । তিনি এবং তাহার সঙ্গে সকলেই আসিল । রামচন্দ্র রামমোহনকে দেখিয়াই ক্ৰোধে অভিভূত হইয়া কহিলেন, “তোকে আমি এখনই ছাড়াইয়া দিলাম, তুই দূর হইয়া যা । তুই পুরানো লোক, তোকে আর অধিক কী শাস্তি দিব । যদি এ-যাত্রা বঁাচিয়া যাই। তবে তোর মুখ আর আমি দেখিব না।” বলিতে বলিতে রামচন্দ্রের কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল । তিনি যথার্থই রামমোহনকে ভালোবাসিতেন, শিশুকাল হইতে রামমোহন তাহাকে পালন করিয়া আসিতেছে । রামমোহন জোড়হাত করিয়া কহিল, “তুমি আমাকে ছাড়াইবার কে, মহারাজ ? আমার এ চাকরি ভগবান দিয়াছেন । যেদিন যমের তলব পাড়িবে, সেদিন ভগবান আমার এ চাকরি ছাড়াইবেন ! তুমি আমাকে রাখ না রাখা আমি তোমার চাকর ।” বলিয়া সে রামচন্দ্ৰকে আগলাইয়া দাড়াইল । উদয়াদিত্য কহিলেন, “রামমোহন, কী উপায় করিলে ?” রামমোহন কহিল, “আপনার শ্ৰীচরণশীর্বাদে এই লাঠিই উপায় । আর মা কালীর চরণ ভরসা ।” উদয়াদিত্য ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ও উপায় কোনো কাজের নয় । আচ্ছা রামমোহন, তোমাদের নীেকা কোন দিকে আছে ?” রামমোহন কহিল, “রাজবাটীর দক্ষিণ পাশ্বের খালে ।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “চলো একবার ছাদে যাই ।” রামমোহনের মাথায় হঠাৎ একটা উপায় উদ্ভাবিত হইল— সে কহিল, “হা, ঠিক কথা, সেইখানে চলুন ।” সকলে প্রাসাদের ছাদে উঠিলেন । ছাদ হইতে প্ৰায় সত্তর হাত নীচে খাল । সেই খালে রামচন্দ্রের চৌষট্টি দাড়ের নীেকা ভাসিতেছে। রামমোহন কহিল, রামচন্দ্র রায়কে পিঠে বাধিয়া লইয়া সে সেইখানে বঁাপাইয়া পড়িবে। বসন্ত রায় তাড়াতাড়ি শশব্যস্ত হইয়া রামমোহনকে ধরিয়া বলিয়া উঠিলেন, “না না না, সে কি হয় ?