পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 O রবীন্দ্র-রচনাবলী রামমোহন, তুমি আমন অসম্ভব কাজ করিতে যাইয়ো না ।” বিভা চমকিয়া সত্ৰাসে বলিয়া উঠিল, “না মোহন, তুই ও কী বলিতেছিস ।” তখন উদয়াদিত্য অন্তঃপুরে গিয়া কতকগুলা খুব মোটা বৃহৎ চাদর সংগ্ৰহ করিয়া আনিলেন । রামমোহন সেগুলি পাকাইয়া বাধিয়া বাধিয়া একটা প্ৰকাণ্ড রজজুর মতো প্ৰস্তুত করিল। যেদিকে নেকি? ছিল, সেইদিককার ছাদের উপরের একটি ক্ষুদ্র স্তম্ভের সহিত রজজু বাধিল । রজজু নীেকার কিঞ্চিৎ উর্ধের্ব গিয়া শেষ হইল । রামমোহন রামচন্দ্র রায়কে কহিল, “মহারাজ, আপনি আমার পিঠ জড়াইয়া ধরিবেন, আমি রজজু বাহিয়া নামিয়া পড়িব ।” রামচন্দ্ৰ তাহাতে অগত্যা সম্মত হইলেন । তখন রামমোহন সকলকে একে একে প্ৰণাম করিল ও সকলের পদধূলি লইল, কহিল, “জয় মা কালী |" রামচন্দ্ৰকে পিঠে তুলিয়া লইল, রামচন্দ্ৰ চোখ বুজিয়া প্ৰাণপণে তাহার পিঠ আঁকড়িয়া ধরিলেন । বিভার দিকে চাহিয়া রামমোহন কহিল, “মা, তবে আমি চলিলাম । তোমার সন্তান থাকিতে কোনো ভয় করিয়ো না ।” রামমোহন রজজু আঁকড়াইয়া ধরিল। বিভা স্তম্ভে ভর দিয়া প্ৰাণপণে দাড়াইয়া রহিল । বৃদ্ধ বসন্ত রায় কম্পিত চরণে দাড়াইয়া চােখ বুজিয়া “দুৰ্গা” “দুৰ্গা” জপিতে লাগিলেন । রামমোহন রজ বাহিয়া নামিয়া রজজুর শেষ প্রান্তে গেল । তখন সে হাত ছাড়িয়া দাত দিয়া রজজু কামড়াইয়া ধরিল ও রামচন্দ্রকে পৃষ্ঠ হইতে ছাড়াইয়া দুই হস্তে ঝুলাইয়া অতি সাবধানে নীেকায় নামাইয়া দিল ও নিজেও লাফাইয়া পড়িল । রামচন্দ্র যেমন নৌকায় নামিলেন। আমনি মূৰ্ছিত হইলেন । রামচন্দ্ৰ যেমন নীেকায় নামিলেন, আমনি বিভা গভীর ও সুদীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িল । বসন্ত রায় চােখ মেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “দাদা, কী হইল ?” উদয়াদিত্য মূৰ্ছিত বিভাকে সস্নেহে কোলে করিয়া অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন । সুরমা উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিল, “এখন তোমার কী হইবে ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমার জন্য আমি ভাবি না ।” এদিকে নৌকা খানিক দূর গিয়া আটক পড়িল ৷ বড়ো বড়ো শাল কাঠে খাল বদ্ধ। এমন সময়ে সহসা প্রহরীরা দূর হইতে দেখিল, নীেক পলাইয়া যায়। পাথর ছুড়িতে আরম্ভ করিল, একটাও গিয়া পৌঁছিল না। প্রহরীদের হাতে তলোয়ার ছিল, বন্দুক ছিল না, একজন বন্দুক আনিতে গেল। খোজ খোজ করিয়া বন্দুক জুটিল তো চকমকি জুটিল না। “ওরে বারুদ কোথায়— গুলি কোথায়” করিতে করিতে রামমোহন ও অনুচরগণ কাঠের উপর দিয়া নীেকা টানিয়া তুলিয়া লইয়া গেল। প্রহরীগণ অনুসরণ করিবার জন্য একটা নৌকা ডাকিতে গেল । যাহার উপরে নীেকা ডাকিবার ভার পড়িল পথের মধ্যে সে হরি মুদির দোকানে এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইল ও রামশংকরকে তাহার বিছানা হইতে উঠাইয়া তাহার পাওনা টাকা শীঘ্ৰ পাইবার অন্য তাগাদা করিয়া গেল । যখন নীেকার প্রয়োজন একেবারে ফুরাইল তখন হাকডাক করিতে করিতে নীেক আসিল । বিলম্ব দেখিয়া সকলে নীেকা-আহবানকারীকে সুদীর্ঘ ভৎসনা করিতে আরম্ভ করিল। সে কহিল, “আমি তো আর ঘোড়া নাই ।” একে একে সকলের যখন ভৎসনা করা ফুরাইল, তখন তাহাদের চৈতন্য হইল, যে নীেকা ধরিবার আর কোনো সম্ভাবনা নাই । নৌকা আনিতে যে বিলম্ব হইয়াছিল, ভৎসনা করিতে তাহার তিন গুণ বিলম্ব হইল । যখন রামচন্দ্রের নৌকা ভৈরব নদে গিয়া পৌছিল তখন ফর্নাণ্ডিজ এক তোপের আওয়াজ করিল। প্রত্যুষে প্রতাপাদিত্যের নিদ্ৰাকর্ষণ হইয়াছিল। সেই তোপের শব্দে সহসা ঘুম ভাঙিয়া গেল । তিনি ডাকিয়া উঠিলেন, “প্রহরী ।” কেহই আসিল না । দ্বারের প্রহরীগণ সেই রাত্রেই পলাইয়া গেছে । প্রতাপাদিত্য উচ্চতর স্বরে ডাকিলেন, “প্রহরী ।”