পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \V8 G? সুরমা দৃঢ়ভাবে উদয়াদিত্যকে আলিঙ্গন করিয়া দৃঢ়স্বরে কহিল, “সে যম পারে, আর কেহ পারে का ।" সুরমার মনেও অনেকক্ষণ ধরিয়া সেইরূপ একটা আশঙ্কা জন্মিতেছে। সে যেন দেখিতে পাইতেছে, একটা কঠোর হস্ত তাহার উদয়াদিত্যকে তাহার কাছ হইতে সরাইয়া দিবার জন্য অগ্রসর হইতেছে । সে মনে মনে উদয়াদিত্যকে প্ৰাণপণে আলিঙ্গন করিয়া ধরিল, মনে মনে কহিল, “আমি ছাড়িব না, আমাকে কেহ ছাড়াইতে পরিবে না ।” সুরমা আবার কহিল, “আমি অনেকক্ষণ হইতে ভাবিয়া রাখিয়াছি আমাকে তোমার কাছ হইতে কেহই লইতে পরিবে না ।” সুরমা ঐ কথা বার বার করিয়া বলিল । সে মনের মধ্যে বল সঞ্চয় করিতে চায়, যে বলে সে উদয়াদিত্যকে দুই বাহু দিয়া এমন জড়াইয়া থাকিবে যে, কোনো পার্থিব শক্তি তাহাদেব বিচ্ছিন্ন করিতে পরিবে না । বার বার ঐ কথা বলিয়া মনকে সে বজের বলে বাধিতেছে । উদয়াদিত্য সুরমার মুখের দিকে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “সুরমা, দাদামহাশয়কে আর দেখিতে পাইব না ।” সুরমা নিশ্বাস ফেলিল । উদয়াদিত্য কহিলেন, “আমি নিজের কষ্টের জন্য ভাবি না। সুরমা, কিন্তু দাদামহাশয়ের প্রাণে যে বড়ো বাজিবে । দেখি বিধাতা আরো কী করেন । তার আরো কী ইচ্ছা আছে।” উদয়াদিত্য বসন্ত রায়ের কত গল্প করিলেন । বসন্ত রায় কোথায় কী কহিয়াছিলেন, কোথায় কী করিয়াছিলেন সমুদায় তাহার মনে পড়িতে লাগিল । বসন্ত রায়ের করুণ হৃদয়ের কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ, কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথা, তাহার স্মৃতির ভাণ্ডারে ছোটাে ছোটাে রত্বের মতো জমা করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাই আজ একে একে সুরমার কাছে বাহির করিতে লাগিলেন । সুরমা কহিল, “আহা, দাদামহাশয়ের মতো কি আর লোক আছে।” সুরমা ও উদয়াদিত্য বিভার ঘরে গেলেন । তখন বিভা তাহার দাদামহাশয়ের পাকা চুল তুলিতেছে, ও তিনি বসিয়া গান গাহিতেছেন, “ওরে, যেতে হবে, আর দেরি নাই, পিছিয়ে পড়ে রবি কত, সঙ্গীরা তোর গেল সবাই । আয় রে ভবের খেলা সোরে, আঁধার করে এসেছে রে, (ওরে) পিছন ফিরে বারে বারে কাহার পানে চাহিসী রে ভাই । খেলতে এল ভবের নাটে, নতুন লোকে নতুন খেলা, হেথা হতে আয় রে সরে, নইলে তোরে মারবে ঢেলা, নামিয়ে দে রে প্রাণের বোঝা, আর এক দেশে চল রে সোজা, (সেথা) নতুন করে বাধবি বাসা, নতুন খেলা খেলবি সে ঠাই ।” উদয়াদিত্যকে দেখিয়া বসন্ত রায় হাসিয়া কহিলেন, “দেখো ভাই, বিভা আমাকে ছাড়িতে চায় না । কী জানি আমাকে উহার কিসের আবশ্যক। এক কালে যে দুধ ছিল, বুড়া হইয়া সে ঘোল হইয়া উঠিয়াছে, তা বিভা দুধের সাধ ঘোলে মিটাইতে চায় কেন ? আমি যাব শুনিয়া বিভা কঁাদে ! এমন আর কখনো শুনিয়াছ ? আমি ভাই বিভার কান্না দেখিতে পারি না।” বলিয়া গাহিতে লাগিলেন, আমায় কেন রাখিস ধরে, চোখের জলের বঁাধন দিয়ে বাধিস নে আর মায়াডোরে ।