পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ(z O রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রতিবিধান করিতে আসিলেন। দেখি, তিনি দয়া করিয়া কী করিতে পারেন। আমি যেখানে নিষ্ঠুর সেখানে আর যে কেহ দয়ালু হইবে, এতবড়ো আস্পর্ধা কাহার প্রাণে সয় ।” উদয়াদিত্য সুরমার কাছে গিয়া সমস্ত কহিলেন । সুরমা কহিল, “সেদিন সমস্ত দিন কিছু খাইতে পায় নাই, সন্ধ্যাবেলায় সীতারামের মা সীতারামের ছোটো মেয়েটিকে লইয়া আমার কাছে আসিয়া কঁদিয়া পড়িল । আমি সেই সন্ধ্যাবেলায় কিছু দিই, তবে তাহারা সমস্ত পরিবার খাইতে পায় । সীতারামের মেয়েটি দুধের মেয়ে, সমস্ত দিন কিছু খায় নাই, তাহার মুখপানে কি তাকানো যায়। ইহাদের কিছু কিছু না দিলে ইহারা যাইবে কোথায় ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “বিশেষত রাজবাটী হইতে যখন তাহারা তাড়িত হইয়াছে, তখন পিতার ভয়ে অন্য কেহ তাঁহাদের কর্ম দিতে বা সাহায্য করিতে সাহস করিবে না, এ-সময়ে আমরাও যদি বিমুখ হই তাহা হইলে তাঁহাদের আর সংসারে কেহই থাকিবে না। সাহায্য আমি করিবই, তাহার জন্য ভাবিয়ে না। সুরমা, কিন্তু অনৰ্থক পিতাকে অসন্তুষ্ট করা ভালো হয় না, যাহাতে এ-কাজটা গোপনে সমাধা করা যায়, তাহার উপায় করিতে হইবে।” সুরমা উদয়াদিত্যের হাত ধরিয়া কহিল, “তােমাকে আর কিছু করিতে হইবে না, আমি সমস্ত করিব । আমার উপরে ভার দাও।” সুরমা নিজেকে দিয়া উদয়াদিত্যকে ঢাকিয়া রাখিতে চায় । এই বৎসরটা উদয়াদিত্যের দুর্বৎসর পড়িয়াছে। অদৃষ্ট তাহাকে যে-কাজেই প্ৰবৃত্ত করাইতেছে, সবগুলিই তাহার পিতার বিরুদ্ধে ; অথচ সেগুলি এমন কাজ যে, সুরমার মতো স্ত্রী প্ৰাণ ধরিয়া স্বামীকে সে-কাজ হইতে নিবৃত্ত করিতে পারে না । সুরমা তেমন স্ত্রী নহে। স্বামী যখন ধর্মযুদ্ধে যান, তখন সুরমা নিজের হাতে তাহার বর্ম বাধিয়া দেয়, তাহার পর ঘরে গিয়া সে কঁদে । সুরমার প্রাণ প্রতি পদে ভয়ে আকুল হইয়াছে, অথচ উদয়াদিত্যকে সে প্রতি পদে ভরসা দিয়াছে। উদয়াদিত্য ঘোর বিপদের সময় সুরমার মুখের দিকে চাহিয়াছেন, দেখিয়াছেন সুরমার চােখে জল, কিন্তু সুরমার হাত কঁপে নাই, সুরমার পদক্ষেপ অটল । সুরমা তাহার এক বিশ্বস্তা দাসীর হাত দিয়া সীতারামের মায়ের কাছে ও ভাগবতের স্ত্রীর কাছে বৃত্তি পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন । দাসী বিশ্বস্তা বটে, কিন্তু মঙ্গলার কাছে। এ কথা গোপন রাখিবার সে কোনো আবশ্যক বিবেচনা করে নাই | এই নিমিত্ত মঙ্গলা ব্যতীত বাহিরের আর কেহ অবগত ছিল না । ষোড়শ পরিচ্ছেদ যখন গোপনে বৃত্তি পাঠানোর কথা প্রতাপাদিত্যের কানে গেল, তখন তিনি কথা না কহিয়া অন্তঃপুরে আদেশ পাঠাইয়া দিলেন, সুরমাকে পিত্ৰালয়ে যাইতে হইবে । উদয়াদিত্য বক্ষে দৃঢ় বল বাধিলেন । বিভা কাদিয়া সুরমার গলা জড়াইয়া কহিল, “তুমি যদি যাও, তবে এ শ্মশানপুরীতে আমি আমার সর্বস্ব এখানে রহিয়াছে।” সুরমা যখন প্রতাপাদিত্যের আদেশ শুনিল, তখন কহিল, “আমি পিত্ৰালয়ে যাইবার কোনো কারণ দেখিতেছি না । সেখান হইতে আমাকে লাইতে লোক আসে নাই, আমার স্বামীরও এ-বিষয়ে মত নাই । অতএব বিনা কারণে সহসা পিত্ৰালয়ে যাইবার আমি কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না ।” শুনিয়া প্রতাপাদিত্য জ্বলিয়া গেলেন । কিন্তু ভাবিয়া দেখিলেন, কোনো উপায় নাই। সুরমাকে কিছু বলপূর্বক বাড়ি হইতে বাহির করা যায় না, অন্তঃপুরে শারীরিক বল খাটে না । প্রতাপাদিত্য মেয়েদের বিষয়ে নিতান্ত আনাড়ি ছিলেন, বলের প্রতি বল প্রয়োগ করিতে তিনি জানিতেন, কিন্তু এই অবলাদের সম্বন্ধে কিরূপ চাল চালিতে হয়, তাহা তাহার মাথায় আসিত না । তিনি বড়ো বড়ো কাছি টানিয়া ছিড়িতে পারেন। কিন্তু র্তাহার মোটা মোটা অঙ্গুলি দিয়া ক্ষীণ সূত্রের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম গ্ৰন্থি মোচন করিতে পারেন না । এই মেয়েগুলা তঁহার মতে নিতান্ত দুর্জেয় ও জানিবার