পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ኃ(፩ S অনুপযুক্ত সামগ্ৰী । ইহাদের সম্বন্ধে যখনই কোনো গোল বাধে, তিনি তাড়াতাড়ি মহিষীর প্রতি ভার দেন । ইহাদের বিষয়ে ভাবিতে বসিতে তাহার অবসরও নাই, ইচ্ছাও নাই এবং যোগ্যতাও নাই । ইহা তাহার নিতান্ত অনুপযুক্ত কাজ । এবারেও প্রতাপাদিত্য মহিষীকে ডাকিয়া কহিলেন, “সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠাও।” মহিষী কহিলেন, “তাহা হইলে বাবা উদয়ের কী হইবে।” প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “উদয় তো আর ছেলেমানুষ নয়, আমি রাজকার্যের অনুরোধে সুরমাকে রাজপুরী হইতে দূরে পাঠাইতে চাই, এই আমার আদেশ ।” মহিষী উদয়াদিত্যকে ডাকাইয়া কহিলেন, “বাবা উদয়, সুরমাকে বাপের বাড়ি পাঠানো যাক ৷” উদয়াদিত কহিলেন, “কেন মা, সুরমা কী অপরাধ করিয়াছে ?” মহিষী কহিলেন, “কী জানি বাছা, আমরা মেয়েমানুষ, কিছু বুঝি না, বউমাকে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া মহারাজার রাজকার্যে যে কী সুযোগ হইবে, তা মহারাজই জানেন ।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “মা, আমাকে কষ্ট দিয়া আমাকে দুঃখী করিয়া রাজকার্যের কী উন্নতি হইল ? যতদূর কষ্ট সহিবার তাহা তো সহিয়াছি, কোন সুখ আমার অবশিষ্ট আছে ? সুরমা যে বড়ো সুখে আছে তাহা নয় । দুই সন্ধ্যা সে ভৎসনা সহিয়াছে, “দূর ছাই সে অঙ্গ-আভরণ করিয়াছে, অবশেষে কি রাজবাড়িতে তাহার জন্য একটুকু স্থানও কুলাইল না । তোমাদের সঙ্গে কি তাহার কোনো সম্পর্ক নাই মা ? সে কি ভিখারি অতিথি যে, যখন খুশি রাখিবে, যখন খুশি তাড়াইবে ? তাহা হইলে মা, আমার জন্যও রাজবাড়িতে স্থান নাই, আমাকেও বিদায় করিয়া দাও।” মহিষী কাদিতে আরম্ভ করিলেন, কহিলেন, “কী জানি বাবা । মহারাজা কখন কী যে করেন, কিছু বুঝিতে পারি না । কিন্তু তাও বলি বাছা, আমাদের বউমাও বড়ো ভালো মেয়ে নয়। ও রাজবাড়িতে প্ৰবেশ করিয়া অবধি এখানে আর শান্তি নাই ৷ হাড় জ্বালাতন হইয়া গেল । তা ও দিনকতক বাপের বাড়িতেই যাক-না কেন, দেখা যাক । কী বল বাছা ! ও দিনকতক এখান হইতে গেলেই দেখিতে পাইবে, বাড়ির শ্ৰী ফেরে কি না ।” M উদয়াদিত্য এ কথার আর কোনো উত্তর করিলেন না, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন, তাহার পরে উঠিয়া চলিয়া গেলেন । মহিষী কাদিয়া প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া পড়িলেন, কহিলেন, “মহারাজ, রক্ষা করো ! সুরমাকে পাঠাইলে উদয় বাচিবে না । বাছার কোনো দোষ নাই, ঐ সুরমা ঐ ডাইনীটা তাহাকে কী মন্ত্র করিয়াছে।” বলিয়া মহিষী কাদিয়া আকুল হইলেন । প্রতাপাদিত্য বিষম রুষ্ট হইয়া কহিলেন, “সুরমা যদি না যায় তো আমি উদয়াদিত্যকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিব ।” মহিষী মহারাজার কােছ হইতে আসিয়া সুরমার কাছে গিয়া কহিলেন, “ পোড়ামুখী, আমার বাছাকে তুই কী করিলি ? আমার বাছাকে আমাকে ফিরাইয়া দে । আসিয়া অবধি তুই তাহার কী সর্বনাশ না করিলি ? অবশেষে- সে রাজার ছেলে, তার হাতে বেড়ি না দিয়া কি তুই ক্ষান্ত হইবি না ?” সুরমা শিহরিয়া উঠিয়া কহিল, “আমার জন্য র্তার হাতে বেড়ি পড়িবে ? সে কী কথা মা । আমি এখনই চলিলাম ।” সুরমা বিভার কাছে গিয়া সমস্ত কহিল। বিভার গলা ধরিয়া কহিল, “বিভা এই যে চলিলাম, আর বোধ করি আমাকে এখানে ফিরিয়া আসিতে দিবে না।” বিভা কাদিয়া সুরমাকে জড়াইয়া ধরিল। সুরমা সেইখানে বসিয়া পড়িল । অনন্ত ভবিষ্যতের অনন্ত প্ৰান্ত হইতে একটা কথা আসিয়া তাহার প্ৰাণে বাজিতে লাগিল, “আর হইবে না !” আর আসিতে পাইব না, আর হইবে না, আর কিছু রহিবে না ! এমন একটা মহাশূন্য ভবিষ্যৎ তাহার সম্মুখে প্রসারিত হইল— যে ভবিষ্যতে সে সুখ নাই, সে হাসি নাই, সে আব্দর নাই, চােখে চােখে বুকে বুকে প্ৰাণে প্ৰাণে মিলন নাই, সুখদুঃখের বিনিময় নাই, বুক ফাটিয়া গেলেও এক মুহুর্তের জন্যও একবিন্দু প্ৰেম নাই, মেহ নাই, কিছু নাই, কী ভয়ানক ভবিষ্যৎ । সুরমার বুক ফাটিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল, চোখের জল শুকাইয়া গেল। উদয়াদিত্য