পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VGA এখনো বিভার প্রতি রামচন্দ্র রায়ের আসক্তির মতো একটা ভােব আছে। বিভা সুন্দরী, বিভা সবেমাত্র যৌবনে পদার্পণ করিয়াছে। রামচন্দ্র রায়ের সহিত বিভার অতি অল্পদিনই সাক্ষাৎ হইয়াছে। প্রতাপাদিত্যের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করিয়াছেন— কিন্তু যখন সেই রাত্রে প্রথম নিদ্ৰা ভাঙিয়া সহসা তিনি দেখিলেন, বিভা শয্যায় বসিয়া কঁাদিতেছে, তাহার মুখে জ্যোৎস্না পড়িয়াছে, তাহার অর্ধ-অনাবৃত বক্ষ কঁপিয়া কঁপিয়া উঠিতেছে, তাহার মধুর করুণ দুটি চক্ষু বহিয়া জল পড়িতেছে, তাহার ক্ষুদ্র দুটি অধৱ কচি কিশলয়ের মতে কঁাপিতেছে, তখন তাহার মনে সহসা একটা কী উচ্ছাস হইল, বিভার মাথা কোলে রাখিলেন, চােখের জল মুছাইয়া দিলেন, বিভার করুণ অধর চুম্বন করিবার জন্য হৃদয়ে একটা আবেগ উপস্থিত হইল, তখনই প্রথম তাহার শরীরে মুহুর্তের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চার হইল, তখনই প্রথম তিনি বিভার নববিকশিত যৌবনের লাবণ্যরাশি দেখিতে পাইলেন, সেই প্রথম তাহার নিশ্বাস বেগে বহিল, অর্ধনিমীলিত নেত্রপল্লবে জলের রেখা দেখা দিল, হৃদয় বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল । বিভাকে চুম্বন করিতে গেলেন । এমন সময়ে দ্বারে আঘাত পড়িল, এমন সময়ে বিপদের সংবাদ শুনিতে পাইলেন । সেই যে হৃদয়ের প্রথম বিকাশ, সেই যে বাসনার প্রথম উচ্ছাস, সেই যে নয়নের মোহর্দৃষ্টি, তাহা পরিতৃপ্ত হইল না বলিয়া তাহারা তুষাকাতর হইয়া রামচন্দ্র রায়ের স্মৃতি অধিকার করিয়া রহিল । ইহা স্থায়ী প্রেমের ভাব নহে, কারণ রামচন্দ্র রায়ের লঘু হৃদয়ের পক্ষে তাহা সম্ভব নহে । একটা বিলাসদ্রব্যের প্রতি শৌখিন হৃদয়ের যেমন সহসা একটা টান পড়ে, শৌখিন রামচন্দ্ৰ রায়েরও বিভার প্রতি সেইরূপ একটা ভােব জন্মিয়ছিল। যাহা হউক, যে-কারণেই হউক রামচন্দ্র রায়ের যৌবনস্বপ্নে বিভা জাগিতেছিল । বিভাকে পাইবার জন্য র্তাহার একটা অভিলাষ উদয় হইয়াছিল । কিন্তু যদি বিভাকে আনিতে পাঠান, তাহা হইলে সকলে কী মনে করিবে । সভাসদেরা যে তাহাকে স্ত্ৰৈণ মনে করিবে, মন্ত্রী যে মনে মনে অসন্তুষ্ট হইবে, রামাই ভাড় যে মনে মনে . হাসিবে । তাহা ছাড়া, প্রতাপাদিত্যের তাহা হইলে কী শাস্তি হইল ? শ্বশুরের উপর প্রতিহিংসা তোলা হইল কই ? এইরূপ সাত-পাচ ভাবিয়া বিভাকে আনিতে পাঠাইতে তাহার ভরসা হয় না, প্ৰবৃত্তি হয় না । এমন-কি, বিভাকে লইয়া হাস্যপরিহাস চলিতে থাকে, তাহাতে বাধা দিতেও তাহার সাহস হয় না এবং প্রতাপাদিত্যের কথা মনে করিয়া তাহাতে বাধা দিতে তাহার ইচ্ছাও হয় না । রামাই ভাড় ও মন্ত্রী চলিয়া গেলে রামমোহন মাল আসিয়া জোড়হাতে কহিল, “মহারাজ ।” রামমোহন । মহারাজ, আজ্ঞা দিন, আমি ঠাকুরানীকে আনিতে যাই । রাজা কহিলেন, “সে কী কথা !” রামমোহন কহিল, “আজ্ঞা হাঁ । অন্তঃপুর শূন্য হইয়া আছে, আমি তাহা দেখিতে পারিব না । অন্তঃপুরে যাই, মহারাজের ঘরে কাহাকেও দেখিতে পাই না, আমার যেন প্ৰাণ কেমন করিতে থাকে । আমার মা-লক্ষ্মী গৃহে আসিয়া গৃহ উজ্জ্বল করুন আমরা দেখিয়া চক্ষু সার্থক করি।” রাজা কহিলেন, “রামমোহন, তুমি পাগল হইয়াছ ? সে-মেয়েকে আমি ঘরে আনি ?” নেত্ৰ বিস্ফারিত করিয়া কহিল, “কেন মহারাজ, আমার মা-ঠাকুরানী কী অপরাধ করিয়াছেন ?” রাজা কহিলেন, “বল কী রামমােহন ! প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে আমি ঘরে আনিব ?” । রামমোহন কহিল, “কেন আনিবেন না ? প্রতাপাদিত্যের সহিত র্তাহার সম্পর্ক কিসের ? যতদিন বিবাহ না হয় ততদিন মেয়ে বাপের ; বিবাহ হইলে পর আর তাহাতে বাপের অধিকার থাকে না । এখন আপনার মহিষী আপনার- আপনি যদি তাহাকে ঘরে না আনেন, আপনি যদি তাহাকে সমাদর না করেন, তবে আর কে করিবে ?” রাজা কহিলেন, “প্ৰতাপাদিত্যের মেয়েকে যে আমি বিবাহ করিয়াছি, ইহাই যথেষ্ট হইয়াছে, আবার তাহাকে ঘরে আনিব ? তাহা হইলে মান রক্ষা হইবে কী করিয়া ?” রামমোহন কহিল, “মান রক্ষা ? আপনার নিজের মহিষীকে আপনি পরের ঘরে ফেলিয়া S8S