পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VVV) দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ ভাগবতের অবস্থা বড়ো ভালো নহে। সে চুপচাপ বসিয়া কয়দিন ধরিয়া অনবরত তামাক ফকিতেছে। ভাগবত যখন মনোযোগের সহিত তামাক ফুকিতে থাকে, তখন প্রতিবেশীদের আশঙ্কার কারণ উপস্থিত হয় । কারণ, তাহার মুখ দিয়া কালো কালো ধোয়া পাকাইয়া পাকাইয়া উঠিতে থাকে, তাহার মনের মধ্যেও তেমনি একটা কৃষ্ণবৰ্ণ পাকচক্রের কারখানা চলিতে থাকে । কিন্তু ভাগবত লোকটা বড়ো ধর্মনিষ্ঠ । সে কাহারও সঙ্গে মেশে না এই যা তাহার দােষ, হরিনামের মালা লইয়া থাকে, অধিক কথা কয় না, পরিচর্চায় থাকে না। কিন্তু কেহ যখন ঘোরতর বিপদে পড়ে, তখন ভাগবতের মতো পাকা পরামর্শ দিতে আর কেহ পারে না । ভাগবত কখনো ইচ্ছা করিয়া পরের অনিষ্ট করে না, কিন্তু আর কেহ যদি তাহার অনিষ্ট করে তবে ভাগবত ইহজন্মে তাহা কখনো ভোলে না, তাহার শোধ তুলিয়া তবে সে হাঁকা নামাইয়া রাখে । এক কথায়, সংসারে যাহাকে ভালো বলে ভাগবত তাহাই । পাড়ার লোকেরাও তাহাকে মান্য করে, দুরবস্থায় ভাগবত ধার করিয়াছিল, কিন্তু ঘটিবাটি বেচিয়া তাহা শোধ করিয়াছে । একদিন সকালে সীতারাম আসিয়া ভাগবতকে জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, কেমন আছ হে ?” ভাগবত কহিল, “ভালো না ।” - সীতারাম কহিল, “কেন বলো দেখি ?” ভাগবত কিয়ৎক্ষণ তামাক টানিয়া সীতারামের হাতে ইকা দিয়া কহিল, “বড়ো টানাটানি সীতারাম কহিল, “বটে ? তা কেমন করিয়া হইল ?” ভাগবত মনে মনে কিঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়া কহিল, “কেমন করিয়া হইল ? তোমাকেও তাহা বলিতে হইবে নাকি ? আমি তো জানিতাম আমারও যে দশা তোমারও সে দশা ।” সীতারাম কিছু অপ্ৰস্তুত হইয়া কহিল, “না হে, আমি সে কথা কহিতেছি না, আমি বলিতেছি। তুমি ধার কর না কেন ?" ভাগবত কহিল, “ধার করিলে তো শুধিতে হইবে । শুধিব কী দিয়া ? বিক্রি করিবার ও বাধা দিবার জিনিস বড়ো অধিক নাই ।” সীতারাম সগর্বে কহিল, “তোমার কত টাকা ধার চাই, আমি দিব ।” ভাগবত কহিল, “বটে ? তা এতই যদি তোমার টাকা হইয়া থাকে যে এক মুঠ জলে ফেলিয়া দিলেও কিছু না আসে যায়, তাহা হইলে আমাকে গোটা দশেক দিয়া ফেলো। কিন্তু আগে হইতে বলিয়া রাখিতেছি, আমার শুধিবার শক্তি নাই!” সীতারাম কহিল, “সেজন্যে দাদা তোমাকে ভাবিতে হইবে না ।” সীতারামের কাছে এইরূপ সাহায্যপ্ৰাপ্তির আশা পাইয়া ভাগবত বন্ধুতার উচ্ছাসে যে নিতান্ত সুপ্তি হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা নহে। আর এক ছলিম তামাক সাজিয়া চুপ কৰিয়া বসিয়া টানিতে १ऴ्न | সীতারাম আস্তে আস্তে কথা পাড়িল, “দাদা, রাজার অন্যায় বিচারে আমাদের তো অন্ন মারা গেল ।” ভাগবত কহিল, “কই, তোমার ভাবে তো তাহা বোধ হইল না।” সীতারামের বদান্যতা ভাগবতের বড়ো সহ্য হয় নাই, মনে মনে কিছু চটিয়াছিল। সীতারাম কহিল, “না ভাই, কথার কথা বলিতেছি । আজ না যায় তো দশ দিন পরে তো যাইবে।” ভাগবত কহিল, “তা, রাজা যদি অন্যায় বিচার করেন তো আমরা কী করিতে পারি।” সীতারাম কহিল, “আহা, যুবরাজ যখন রাজা হইবে তখন যশোরে রামরাজত্ব হইবে, ততদিন যেন আমরা বাচিয়া থাকি ৷”