পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

2Vobr রবীন্দ্র-রচনাবলী একদিন সভায় মন্ত্রী প্ৰস্তাব করিলেন, “মহারাজ, আপনি আর-একটি বিবাহ করুন।” রামাই ভাড় কহিল, “আর প্রতাপাদিত্যের মেয়ে তাহার ভাইকে লইয়া থাকুক।” রাজা রমাইয়ের দিকে চাহিয়া হাসিয়া কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ রামাই ।” রাজাকে হাসিতে দেখিয়া সকল সভাসদই হাসিতে লাগিল। কেবল ফর্নান্ডিজ বিরক্ত হইল, সে হাসিল না। রামচন্দ্র রায়ের মতো লোকেরা সম্রাম রক্ষার জন্য সততই ব্যস্ত, কিন্তু সন্ত্ৰম কাহাকে বলে ও কী করিয়া সম্রাম রাখিতে হয়। সে জ্ঞান তাহদের নাই । দেওয়ানজি কহিলেন, “মন্ত্রী মহাশয় ঠিক বলিয়াছেন । তাহা হইলে প্রতাপাদিত্যকে ও তাহার কন্যাকে বিলক্ষণ শিক্ষা দেওয়া হইবে ।” রামাই ভাড় কহিল, “এ শুভকার্যে আপনার বর্তমান শ্বশুর মহাশয়কে একখানা নিমন্ত্রণপত্ৰ পাঠাইতে ভুলিবেন না, নহিলে কী জানি তিনি মনে দুঃখ করিতে পারেন।” বলিয়া রামাই চােখ টিপিল । সভাস্থ সকলে হাসিতে লাগিল। যাহারা দূরে বসিয়াছিল, কথাটা শুনিতে পায় নাই, তাহারাও না হাসিয়া কিছুতেই থাকিতে পারিল না । রামাই কহিল, “বরণ করিবার নিমিত্ত এয়োস্ত্রীদের মধ্যে যশোরে আপনার শাশুড়িঠাকরুনকে ডাকিয়া পাঠাইবেন । আর মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ, প্রতাপাদিত্যের মেয়েকে যখন একথাল মিষ্টান্ন পাঠাইবেন তখন রাজা হাসিয়া অস্থির হইলেন। সভাসদেরা মুখে চাদর দিয়া মুখ বাকাইয়া হাসিতে লাগিল । ফর্নাণ্ডিজ অলক্ষিতভাবে উঠিয়া চলিয়া গেল । দেওয়ানজি একবার রসিকতা করিবার চেষ্টা করিলেন, কহিলেন, “মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ- যদি ইত্যর লোকের ভাগ্যেই মিষ্টান্ন থাকে, তাহা হইলে যশোহরেই সমস্ত মিষ্টান্ন খরচ হইয়া যায়, চন্দ্ৰদ্বীপে আর মিষ্টান্ন খাইবার উপযুক্ত লোক থাকে না ।” কথাটা শুনিয়া কাহারও হাসি পাইল না । রাজা চুপ করিয়া গুড়গুড়ি টানিতে লাগিলেন, সভাসদেরা গভীর হইয়া রহিল, রামাই দেওয়ানের দিকে একবার অবাক হইয়া চাহিল, এমন-কি, একজন অমাত্য বিশেষভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “সে কী কথা দেওয়ানজি মহাশয় । রাজার বিবাহে মিষ্টান্নের বন্দোবস্ত কি এত কম হইবে ?” দেওয়ানজি মহাশয় মাথা চুলকাইতে লাগিলেন । বিবাহের কথা সমস্ত স্থির হইয়া গেল । পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ উদয়াদিত্যকে যেখানে রুদ্ধ করা হইয়াছে তাহা প্রকৃত কারাগার নহে ; তাহা প্রাসাদসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র অট্টালিকা। বাটীর ঠিক ডানপাশেই এক রাজপথ ও তাহার পূর্ব দিকে প্রশস্ত এক প্রাচীর আছে, তাহার উপর প্রহরীরা পায়চারি করিয়া পাহারা দিতেছে। ঘরেতে একটি অতি ক্ষুদ্র জানালা কাটা । তাহার মধ্য দিয়া খানিকটা আকাশ, একটা বঁাশঝাড় ও একটি শিবমন্দির দেখা যায়। উদয়াদিত্য প্রথম যখন কারাগারে প্রবেশ করিলেন, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। জানালার কাছে মুখ রাখিয়া ভূমিতে গিয়া বসিলেন । বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ জমিয়া আছে। রাস্তায় জল দাড়াইয়াছে। নিস্তব্ধ রাত্রে দৈবাৎ দুই-একজন পথিক চলিতেছে, ছপ ছপা করিয়া তাহাদের পায়ের শব্দ হইতেছে। পূর্ব দিক হইতে কারাগারের হৃৎস্পন্দন-ধ্বনির মতো প্রহরীদের পদশব্দ অনবরত কানে আসিতেছে । এক-এক প্রহর অতীত হইতে লাগিল, দূর হইতে এক-একটা হাক শোনা যাইতেছে। আকাশে একটিমাত্র তারা নাই । যে বঁাশঝাড়ের দিকে উদয়াদিত্য চাহিয়া আছেন তাহা জোনাকিতে একেবারে ছাইয়া ফেলিয়াছে । সে রাত্ৰে উদয়াদিত্য আর শয়ন করিলেন না, জানালার কাছে বসিয়া প্রহরীদের অবিরাম পদশব্দ শুনিতে লাগিলেন । বিভা আজ সন্ধ্যাবেলায় একবার অন্তঃপুরের বাগানে গিয়াছে। প্রাসাদে বোধ করি অনেক লোক । চারি দিকে দাসদাসী, চারি দিকেই পিসি মাসি । কথায় কথায় কী হইয়াছে, কী বৃত্তান্ত, জিজ্ঞাসা করে ;