পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VoVoS প্রতি অশ্রুবিন্দুর হিসাব দিতে হয় ; প্রতি দীর্ঘনিশ্বাসের বিস্তৃত ভাষ্য ও সমালোচনা বাহির হইতে থাকে। বিভা বুঝি আর পারে নাই, ছুটিয়া বাগানে আসিয়াছে। সূর্য আজ মেঘের মধ্যেই উঠিয়াছে মেঘের মধ্যেই অস্ত গেল। কখন যে দিনের অবসান হইল ও সন্ধ্যার আরম্ভ হইল বুঝা গেল না । বিকালের দিকে পশ্চিমের মুখে একটুখানি সোনার রেখা ফুটিয়াছিল, কিন্তু দিন শেষ হইতে না হইতেই মিলাইয়া গেল । আঁধারের উপর আঁধার ঘনাইতে লাগিল। দিগন্ত হইতে দিগন্ত আচ্ছন্ন হইয়া গেল । ঘনশ্রেণী ঝাউগাছগুলির মাথাব্য উপর অন্ধকার এমনি করিয়া জমিয়া আসিল যে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা ব্যবধান আর দেখা গেল না, ঠিক মনে হইতে লাগিল যেন সহস্র দীর্ঘ পায়ের উপর ভর দিয়া একটা প্ৰকাণ্ড বিস্তৃত নিস্তব্ধ অন্ধকার দাড়াইয়া আছে। রাত হইতে লাগিল, রাজবাড়ির প্রদীপ একে একে নিবিয়া গেল । বিভা ঝাউগাছের তলায় বসিয়া আছে। বিভা স্বভাবতই ভীরু, কিন্তু আজ তাহার ভয় নাই। কেবল যতই আঁধার বাড়িতেছে ততই তাহার মনে হইতেছে যেন পৃথিবীকে কে তাহার কাছ হইতে কাড়িয়া লইতেছে, যেন সুখ হইতে শান্তি হইতে জগৎ-সংসারের উপকূল হইতে কে তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছে, অতলস্পর্শ অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে সে পড়িয়া গিয়াছে। ক্রমেই ডুবিতেছে, ক্রমেই নামিতেছে, মাথার উপরে অন্ধকার ক্রমেই বাড়িতেছে, পদতলে ভূমি নাই, চারিদিকে কিছুই নাই। আশ্রয় উপকূল জগৎ-সংসার ক্রমেই দূর হইতে দূরে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতে লাগিল যেন একটু একটু করিয়া তাহার সম্মুখে একটা প্ৰকাণ্ড ব্যবধান আকাশের দিকে উঠিতেছে। তাহার ওপারে কত কী পড়িয়া রহিল। প্ৰাণ যেন আকুল হইয়া উঠিল । যেন ওপারে সকলই দেখা যাইতেছে ; সেখানকার সূর্যালোক, খেলাধুলা, উৎসব সকলই দেখা যাইতেছে ; কে যেন ফেলিলেও সে যেন সেদিকে যাইতে দিবে না । বিভা যেন আজ দিব্যচক্ষু পাইয়াছে ; এই চরাচরব্যাপী ঘনঘোর অন্ধকারের উপর বিধাতা যেন বিভার ভবিষ্যৎ অদৃষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন, অনন্ত জগৎ-সংসারে একাকী বসিয়া বিভা যেন তাহাই পাঠ করিতেছে ; তাই তাহার চক্ষে জল নাই, দেহ নিম্পন্দ, নেত্র নির্নিমেষ। রাত্রি দুই প্রহরের পর একটা বাতাস উঠিল, অন্ধকারে গাছপালাগুলা হা হা করিয়া উঠিল। বাতাস অতি দূরে হু হু করিয়া শিশুর কণ্ঠে কঁাদিতে লাগিল। বিভার মনে হইতে লাগিল যেন দূর দূর দূরান্তরে সমুদ্রের তীরে বসিয়া বিভার সাধের স্নেহের প্রেমের শিশুগুলি দুই হাত বাড়াইয়া কঁাদিতেছে, আকুল হইয়া তাহারা বিভাকে ডাকিতেছে, তাহারা কোলে আসিতে চায়, সম্মুখে তাহারা পথ দেখিতে পাইতেছে না, যেন তাহাদের ক্ৰন্দন এই শত যোজন লক্ষ যোজন গাঢ় স্তব্ধ অন্ধকার ভেদ করিয়া বিভার কানে আসিয়া পৌছিল । বিভার প্রাণ যেন কাতর হইয়া কহিল, “কে রে, তোরা কে, তোরা কে কঁদিতেছিস, তোরা কোথায় ।” বিভা মনে মনে যেন এই লক্ষ যোজন অন্ধকারের পথে একাকিনী যাত্রা করিল । সহস্ৰ বৎসর ধরিয়া যেন অবিশ্রান্ত ভ্ৰমণ করিল, পথ শেষ হইল না, কাহাকেও দেখিতে পাইল না । কেবল সেই বায়ুহীন শব্দহীন দিনরাত্রিহীন জনশূন্য তারাশূন্য দিগদিগন্তশূন্য মহান্ধকারের মধ্যে ভূইয়া মূল মাঝে চার দিক হইতে ক্ৰন্দন শুনিতে পাইল, কেবল বাতাস দূর হইতে করতে १ॉब्ल- छ् छ् । সমস্ত রাত্রি অনিদ্রায় কাটিয়া গেল। পরদিন বিভা কারাগারে উদয়াদিত্যের নিকট যাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিল, সেখানে তাহার যাওয়া নিষেধ। সমস্ত দিন ধরিয়া অনেক কাদাকাটি করিল। এমন-কি, স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের কাছে গেল। বিভা তাহার পা জড়াইয়া ধরিল । অনেক কষ্টে সম্মতি পাইল । পরদিন প্ৰভাত হইতে না হইতেই বিভা শয্যা হইতে উঠিয়া কারাগৃহে প্ৰবেশ করিল। গিয়া দেখিল উদয়াদিত্য বিছানায় শোন নাই। ভূমিতলে বসিয়া বাতায়নের উপরে মাথা দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন । দেখিয়া বিভার প্রাণ যেন বুক ফাটিয়া কাদিয়া উঠিতে চাহিল। অনেক কষ্টে রোদন সংবরণ করিল । অতি ধীরে নিঃশব্দে উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বসিল । ক্রমে প্ৰভাত পরিষ্কার হইয়া আসিল । নিকটের বন হইতে পাখিরা গাহিয়া উঠিল । পাশের রাজপথ হইতে পাস্থেরা গান গাহিয়া উঠিল, দুই-একটি রাত্ৰিজাগরণে ক্লান্ত প্রহরী আলো দেখিয়া মৃদুস্বরে গান গাহিতে লাগিল। নিকটস্থ