পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や2° の রবীন্দ্র-রচনাবলী মন্দির হইতে শাখ-ঘণ্টার শব্দ উঠিল । উদয়াদিত্য সহসা চমকিয়া জাগিয়া উঠিলেন । বিভাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “এ কী বিভা, এত সকালে যে ?” ঘরের চারি দিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, “এ কী, আমি কোথায় ?” মুহুর্তের মধ্যে মনে পড়িল, তিনি কোথায় । বিভার দিকে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আঃ ! বিভা, তুই আসিয়াছিস ? কাল তোকে সমস্তদিন দেখি নাই, মনে হইয়াছিল বুঝি তোদের আর দেখিতে পাইব না।” বিভা উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল, “দাদা, মাটিতে বসিয়া কেন ? খাটে বিছানা পাতা রহিয়াছে। দেখিয়া বােধ হইতেছে, একবারও তুমি খাটে বস নাই। এ দুদিন কি তবে ভূমিতেই আসন করিয়াছ ?” বলিয়া বিভা কঁদিতে লাগিল । উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “খাটে বসিলে আমি যে আকাশ দেখিতে পাই না বিভা ৷ জানালার ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া যখন পাখিদের উড়িতে দেখি, তখন মনে হয়, আমারও একদিন খাচা ভাঙিবে, আমিও একদিন ঐ পাখিদের মতো ঐ অনন্ত আকাশে প্ৰাণের সাথে সাতার দিয়া বেড়াইব । এ জানালা হইতে যখন সরিয়া যাই, তখন চারি দিকে অন্ধকার দেখি, তখন ভুলিয়া যাই যে আমার একদিন মুক্তি হইবে, একদিন নিষ্কৃতি হইবে- মনে হয় না জীবনের বেড়ি একদিন ভাঙিয়া যাইবে, এ কারাগার হইতে একদিন খালাস পাইব । বিভা, এ কারাগারের মধ্যে এই দুই হাত জমি আছে যেখানে আসিলেই আমি জানিতে পারি যে আমি স্বভাবতই স্বাধীন ; কোনো রাজা-মহারাজা আমাকে বন্দী করিতে পারে না । আর ঐখানে ঐ ঘরের মধ্যে ঐ কোমল শয্যা, ঐখানেই আমার কারাগার ।” আজ বিভাকে সহসা দেখিয়া উদয়াদিত্যের মনে অত্যন্ত আনন্দ হইল । বিভা যখন তাহার চক্ষে পড়িল, তখন তাহার কারাগারের সমুদয় দ্বারা যেন মুক্ত হইয়া গেল ! সেদিন তিনি বিভাকে কাছে বসাইয়া আনন্দে এত কথা বলিয়াছিলেন যে কারাপ্রবেশের পূর্বে বোধ করি এত কথা কখনো বলেন নাই । বিভা উদয়াদিত্যের সে আনন্দ মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিল । জানি না, এক প্ৰাণ হইতে আর-এক প্ৰাণে কী করিয়া বার্তা যায়, এক প্ৰাণে তরঙ্গ উঠিলে আর-এক প্ৰাণে কী নিয়মে তরঙ্গ উঠে । বিভার হৃদয় পুলকে পুরিয়া উঠিল । তাহার অনেক দিনের উদ্দেশ্য আজ সফল হইল। বিভা সামান্য বালিকা, উদয়াদিত্যকে সে যে আনন্দ দিতে পারে অনেক দিনের পর ইহা সে সহসা আজ বুঝিতে পারিল । হৃদয়ে সে বল পাইল । এতদিন সে চারি দিকে অন্ধকার দেখিতেছিল, কোথাও কিনারা পাইতেছিল না, নিরাশার গুরুভারে একেবারে নত হইয়া পড়িয়ছিল । নিজের উপর তাহার বিশ্বাস ছিল না ; অনবরত সে উদয়াদিত্যের কাজ করিত, কিন্তু বিশ্বাস করিতে পারিত না যে, তাহাকে সুখী করিতে পরিবে । আজ সে সহসা একটা পথ দেখিতে পাইয়াছে, এতদিনকার সমস্ত শ্ৰান্তি একেবারে ভুলিয়া গেল । আজ তাহার চোখে প্ৰভাতের শিশিরের মতো অশ্রািজল দেখা দিল, আজ তাহার অধরে অরুণকিরণের নির্মল হাসি ফুটিয়া উঠিল । বিভাও প্রায় কারাবাসিনী হইয়া উঠিল । গৃহের বাতায়নের মধ্য দিয়া যখনই প্ৰভাত প্ৰবেশ করিত, কারাদ্বার খুলিয়া গিয়া তখনই বিভার বিমল মূর্তি দেখা দিত। বিভা বেতনভোগী ভৃত্যদের কিছুই করিয়া দিত। একটি টিয়াপাখি আনিয়া ঘরে টাঙাইয়া দিল ও প্রতিদিন সকালে অন্তঃপুরের বাগান হইতে ফুল তুলিয়া আনিয়া দিত। ঘরে একখানি মহাভারত ছিল, উদয়াদিত্য বিভাকে কাছে বসাইয়া তাহাই পড়িয়া শুনাইতেন । কিন্তু উদয়াদিত্যের মনের ভিতরে একটি কষ্ট জাগিয়া আছে। তিনি তো ডুবিতেই বসিয়াছেন, তবে কেন এমন সময়ে এই অসম্পূর্ণ-সুখ অতৃপ্ত-আশা সুকুমার বিভাকে আশ্রয়স্বরূপে আলিঙ্গন করিয়া তাহাকে পর্যন্ত ডুবাইতেছেন ? প্রতিদিন মনে করেন বিভাকে বলিবেন, “তুই যা বিভা।” কিন্তু বিভা যখন উষার বাতাস লইয়া উষার আলোক লইয়া তরুণী উষার হাত ধরিয়া কারার মধ্যে প্ৰবেশ করে, যখন সেই মেহের ধন সুকুমার মুখখানি লইয়া কাছে আসিয়া বসে, কত যত্ন কত আদরের দৃষ্টিতে র্তাহার মুখের দিকে একবার চাহিয়া দেখে, কত মিষ্ট স্বরে কত কথা জিজ্ঞাসা করে, তখন তিনি আর