পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○° S রবীন্দ্র-রচনাবলী মহিষী কহিলেন, “নাঃ, কিছু যে হইয়াছে তাহা নহে, তবে বিভাকে তো এক সময়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতেই হইবে।” প্রতাপাদিত্য । সে তো বুঝিলাম, তবে এতদিন পরে আজ যে সহসা তাহা মনে পড়িল ? মহিষী ভীত হইয়া কহিলেন, “ঐ তোমার এক কথা, আমি কি বলিতেছি যে কিছু হইয়াছে ? যদি কিছু হয়—” ــــ۔ প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “হইবে। আর কী ?” s মহিষী । এই মনে করে যদি জামাই বিভাকে একেবারে ত্যাগ করে । বলিয়া মহিষী রুদ্ধকণ্ঠ হইয়া কঁদিতে লাগিলেন । প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন । তাহার চোখ দিয়া অগ্নিকণা বাহির হইল । মহারাজের সেই মূর্তি দেখিয়া মহিষী চােখের জল মুছিয়া তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তাই বলিয়া জামাই কি আর সত্য সত্যই লিখিয়াছে যে ওগো তোমাদের বিভাকে আমি ত্যাগ করিলাম, তাহাকে আর চন্দ্ৰদ্বীপে পাঠাইয়ো না, তাহা নহে- তবে কথা এই, যদি কোনোদিন তাই লিখিয়া বসে '। প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “তখন তাহার বিহিত বিধান করিব, এখন তাহার জন্য ভাবিবার অবসর নাই ।” মহিষী কাদিয়া কহিলেন, “মহারাজ, তোমার পায়ে পড়ি, আমার একটি কথা রাখো, একবার ভাবিয়া দেখো বিভার কী হইবে । আমার পাষাণ প্ৰাণ বলিয়া আজও রহিয়াছে, নহিলে আমাকে যত দূর যন্ত্রণা দিবার তা দিয়াছ । উদয়কে- আমার বাছাকে- বাজার ছেলেকে সামান্য অপরাধীর মতো। রুদ্ধ করিয়াছ । সে আমার কাহারও কোনো অপকার করে না, কিছুতেই লিপ্ত থাকে না, দোষের মধ্যে সে কিছু বোঝে-সোঝে না, রাজকাৰ্য শেখে নাই, প্ৰজা শাসন করিতে জানে না, তাহার বুদ্ধি নাই, তা ভগবান তাহাকে যা করিয়াছেন তাহার দোষ কী ।” বলিয়া মহিষী দ্বিগুণ কঁদিতে লাগিলেন । প্রতাপাদিত্য ঈষৎ বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “ও কথা তো অনেকবার হইয়া গিয়াছে । যে কথা হইতেছিল তাহাই বলো-না ।” মহিষী কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন, “আমারই পোড়া কপাল । বলিব আর কী ! বলিলে কি তুমি কিছু শোন ! একবার বিভার মুখপানে চাও মহারাজ । সে যে কাহাকেও কিছু বলে না— সে কেবল দিনে দিনে শুকাইয়া যায়, ছায়ার মতো হইয়া আসে, কিন্তু সে কথা কহিতে জানে না । তাহার একটা উপায় করো ।” প্রতাপাদিত্য বিরক্ত হইয়া উঠিলেন । মহিষী আর কিছু না বলিয়া ফিরিয়া আসিলেন । সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ ইতিমধ্যে এক ঘটনা ঘটিয়াছে । যখন সীতারাম দেখিল, উদয়াদিত্যকে কারারুদ্ধ করা হইয়াছে, তখন সে আর হাত-পা আছড়াইয়া বঁাচে না । প্রথমেই তো সে রুক্সিণীর বাড়ি গেল । তাহাকে যাহা মুখে আসিল তাঁহাই বলিল । তাহাকে মারিতে যায় আর-কি। কহিল, “সর্বনাশী, তোর ঘরে আগুন আজই আমি রায়গড়ে চলিলাম, রায়গড় হইতে আসি, তার পরে তোর ঐ কালামুখ লইয়া এই শানের উপরে ঘষিব, তোর মুখে চুনকালি মাখাইয়া শহর হইতে বাহির করিয়া দিব, তবে জলগ্ৰহণ করিব।” রুক্সিণী কিয়ৎক্ষণ অনিমেষনেত্ৰে সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া শুনিল, ক্রমে তাহার র্দাতে র্দাতে লাগিল, ঠোঁটে ঠোঁট চাপিল, তাহার হাতের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ হইল, তাহার ঘনকৃষ্ণ ভ্ৰযুগলের উপর মেঘ ঘনাইয়া আসিল, তাহার ঘনকৃষ্ণ চক্ষুতারকায় বিদ্যুৎ সঞ্চিত হইতে লাগিল, তাহার সমস্ত শরীর নিম্পন্দ হইয়া গেল। ক্রমে তাহার স্কুল অধরেীষ্ঠ কঁাপিতে লাগিল, ঘন ভু তরঙ্গিত হইল, অন্ধকার চক্ষে বিদ্যুৎ