পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট y \bԳ Տ শত লোকের দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল । উদয়াদিত্য বুঝিলেন প্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগিয়াছে। অনেকক্ষণ ধরিয়া গােলমাল চলিতে লাগিল— তাহার মন অত্যন্ত অধীর হইয়া উঠিল। সহসা দ্রুতবেগে তাহার কারাগারের দ্বার খুলিয়া গেল। কে একজন তাহার অন্ধকার গৃহে প্রবেশ করিল— তিনি চমকিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে ও ?” সে উত্তর করিল, “আমি সীতারাম, আপনি বাহির হইয়া আসুন ।” সীতারাম কহিল, “যুবরাজ, কারাগৃহে আগুন লাগিয়াছে, শীঘ্ৰ বাহির হইয়া আসুন ।” বলিয়া তাহাকে ধরিয়া প্ৰায় তাহাকে বহন করিয়া কারাগারের বাহিরে লইয়া গেল । অনেক দিনের পর উদয়াদিত্য আজ মুক্ত স্থানে আসিলেন— মাথার উপরে সহসা অনেকটা আকাশ দেখিতে পাইলেন, বাতাস যেন তাহার বিস্তৃত বক্ষ প্রসারিত করিয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিতে লাগিল ! চোখের বাধা চারি দিক হইতে খুলিয়া গেল। সেই অন্ধকার রাত্রে, আকাশের অসংখ্য তারকার দৃষ্টির নিম্নে, বিস্তৃত মাঠের মধ্যে কোমল তৃণজালের উপর দাড়াইয়া সহসা তাহার মনের মধ্যে এক অপরিসীম অনির্বচনীয় আনন্দের উদয় হইল । সেই আনন্দে কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া তাহার পর সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী করিব, কোথায় যাইব ?” অনেক দিন সংকীর্ণ স্থানে বদ্ধ ছিলেন, চলেন ফেরেন নাই— আজ এই বিস্তৃত মাঠের মধ্যে আসিয়া অসহায়ভাবে সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী করিব ? কোথায় যাইব ?” সীতারাম কহিল, “আসুন, আমার সঙ্গে আসুন ।” এ দিকে আগুন খুব জ্বলিতেছে | বৈকালে কতকগুলি প্ৰজা প্রধান কর্মচারীদের নিকট কী একটা নিবেদন করিবার জন্য আসিয়াছিল । তাহারা প্রাসাদের প্রাঙ্গণে একত্র বসিয়াছিল, তাহারাই• প্রথমে আগুনের গোল তোলে। প্রহরীদের বাসের জন্য কারাগারের কাছে একটি দীর্ঘ কুটির শ্রেণী ছিল, সেইখানেই তাহাদের চারপাই বাসন কাপড়াচোপড় জিনিসপত্র সমস্তই থাকে । অগ্নির সংবাদ পাইয়াই যত প্রহরী পারিল সকলেই ছুটিয়া গেল, যাহারা নিতান্তই পারিল না তাহারা হাত-পা আছড়াইতে লাগিল । উদয়াদিত্যের গৃহদ্বারেও দুই-একজন প্রহরী ছিল বটে, কিন্তু সেখানে কড়াক্কড় পাহারা দিবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না । দস্তুর ছিল বলিয়া তাহারা পাহারা দিত মাত্র । কারণ, উদয়াদিত্য এমন শান্তভাবে তাহার গৃহে বসিয়া থাকিতেন যে, বোধ হইত না যে তিনি কখনো পলাইবার চেষ্টা করিবেন। বা তাহার পলাইবার ইচ্ছা আছে। এইজন্য তাহার দ্বারের প্রহরীরা সর্বাগ্রে ছুটিয়া গিয়াছিল ; রাত হইতে লাগিল, আগুন নেবে না- কেহ বা জিনিসপত্র সরাইতে লাগিল, কেহ বা জল ঢালিতে লাগিল । কেহ বা কিছুই না করিয়া কেবল গোলমাল করিয়া বেড়াইতে লাগিল— আগুন নিবিলে পর তাহারাই সকলের অপেক্ষা অধিক বাহবা পাইয়াছিল । এইরূপ সকলে ব্যস্ত আছে, এমন সময়ে একজন স্ত্রীলোক তাহাদের মধ্যে ছুটিয়া আসিল— সে কী একটা বলিতে চায়। কিন্তু তাহার কথা শোনে কে ? কেহ তাহাকে গালাগালি দিল, কেহ তাহাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল, কেহই তাহার কথা শুনিল না । যে শুনিল সে কহিল, “যুবরাজ পলাইলেন তাতে আমার কী মাগী, তোরই বা কী ? সে দয়াল সিং জানে । আমার ঘর ফেলিয়া এখন আমি কোথাও যাইতে পারি না ।” বলিয়া সে ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া গেল। এইরূপ বার বার প্রতিহত হইয়া সেই রমণী অতি প্ৰচণ্ডা হইয়া উঠিল । একজন যাহাকে সম্মুখে পাইল তাহাকেই সবলে ধরিয়া কহিল, “পোড়ারমুখো, তোমরা কি চােখের মাথা খাইয়াছ ? রাজার চাকরি কর সে জ্ঞান কি নাই ? কাল রাজাকে বলিয়া হেঁটােয় কাটা উপরে কাটা দিয়া তোমাদের মাটিতে পুঁতিব। তবে ছাড়িব । যুবরাজ যে পলাইয়া গেল।” "ভালোই হইয়াছে, তোর তাহাতে কী ?” বলিয়া সে তাহাকে উত্তমরূপে প্রহার করিল। যাহারা ঘরে আগুন লাগাইয়াছিল, এ ব্যক্তি তাহদের মধ্যে একজন। প্রহার খাইয়া সেই রমণীর মূর্তি অতি ভীষণ হইয়া উঠিল। ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো তাহার চােখ দুটা জ্বলিতে লাগিল, তাহার চুলগুলা ফুলিয়া উঠিল ; সে দাঁতে দাতে কিড়ামিড় করিতে লাগিল, তাহার সেই মুখের উপর বহ্নিশিখার আভা পড়িয়া