পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \ኃbrS তখন উদয়াদিত্য তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে চলো চলো দাদামহাশয় ।” সীতারামের দিকে চাহিয়া ভুকু কহিল,"মোকাতেই কাগজ-কলম আছে, আনিয়া দিতেছি । শীঘ্ৰ করিয়া লিখিবেন, অধিক সময় ן" উদয়াদিত্য পিতার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করিলেন । মাতাকে লিখিলেন, “মা, আমাকে গর্ভে ধরিয়া তুমি কখনো সুখী হইতে পার নাই। এইবার নিশ্চিন্ত হও মা- আমি দাদামহাশয়ের কাছে যাইতেছি, সেখানে আমি সুখে থাকিব, মেহে থাকিব, তোমার কোনো ভাবনার কারণ থাকিবে না ।” বিভাকে লিখিলেন, “চিরায়ুষ্মতীযু— তোমাকে আর কী লিখিব— তুমি জন্ম জন্ম সুখে থাকো— স্বামিংগৃহে গিয়া সুখের সংসার পাতিয়া সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলিয়া যাও ” লিখিতে লিখিতে উদয়াদিত্যের চোখ জলে পরিয়া আসিল । সীতারাম সেই চিঠি তিনখানি একজন দাড়ির হাত দিয়া প্রাসাদে পঠাইয়া দিল । সকলে নীেকাতে উঠিতেছেন— এমন সময়ে দেখিলেন, কে একজন ছুটিয়া তাহাদের দিকে আসিতেছে । সীতারাম চমকিয়া বলিয়া উঠিল, “ঐ রে— সেই ডাকিনী আসিতেছে।” দেখিতে দেখিতে রুক্মিণী কাছে আসিয়া পৌছিল । তাহার চুল এলোথোলো, তাহার অঞ্চল খসিয়া পড়িয়াছে, তাহার জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো চোখ দুটা অগ্নি উদগার করিতেছে- তাহার বার বার প্রতিহত বাসনা, অপরিতৃপ্ত প্ৰতিহিংসা-প্রবৃত্তির যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সে যেন যাহাকে সম্মুখে পায় তাহাকেই খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিড়িয়া ফেলিয়া রোষ মিটাইতে চায় । যেখানে প্রহরীরা আগুন নিবাইতেছিল, সেখানে বার বার ধাক্কা খাইয়া ক্ৰোধে অধীর হইয়া পাগলের মতো প্রাসাদের মধ্যে প্রবেশ করে-- একেবারে প্রতাপাদিত্যের ঘরের মধ্যে প্ৰবেশ করিবার জন্য বার বার নিম্বফল চেষ্টা করে, প্রহরীরা তাহাকে পাগল মনে করিয়া মারিয়া ধরিয়া তাড়াইয়া দেয় | যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া সে প্রাসাদ হইতে ছুটিয়া আসিতেছে । বাঘিনীর মতো সে উদয়াদিত্যের উপর লাফাইয়া পড়িবার চেষ্টা করিল। সীতারাম মাঝে আসিয়া পড়িল ; চীৎকার করিয়া সে সীতারামের উপর ঝাপাইয়া পড়িল, প্ৰাণপণে তাহাকে দুই হাতে জড়াইয়া ধরিল— সহসা সীতারাম চীৎকার করিয়া উঠিল, দাড়ি মাঝিরা তাড়াতাড়ি আসিয়া বলপূর্বক রুক্মিণীকে ছাড়াইয়া লইল । আত্মঘাতী বৃশ্চিক যেমন নিজের সর্বাঙ্গে হুল ফুটাইতে থাকে, তেমনি সে অধীর হইয়া নিজের বক্ষ নখে আঁচড়াইয়া চুল ছিড়িয়া চীৎকার করিয়া কহিল, “কিছুই হইল না, কিছুই হইল না— এই আমি মরিলাম, এ স্ত্রীহত্যার পাপ তোদের হইবে।” সেই অন্ধকার রাত্রে এই অভিশাপ দিকে দিকে ধ্বনিত হইয়া উঠিল । মুহুর্তমধ্যে বিদ্যুদবেগে রুক্মিণী জলে ঝাপাইয়া পড়িল । বর্ষায় খালের জল অত্যন্ত বাড়িয়াছিল— কোথায় সে তলাইয়া গেল ঠিকানা রহিল না। সীতারামের কঁাধ হইতে রক্ত পড়িতেছিল, চাদর জলে ভিজাইয়া কঁধে বাধিল । নিকটে গিয়া দেখিল, উদয়াদিত্যের কপালে ঘৰ্মবিন্দু দেখা দিয়াছে, তাহার হাত পা শীতল হইয়া গিয়াছে, তিনি প্রায় অজ্ঞান হইয়া গিয়াছেন— বসন্ত রায়ও যেন দিশাহারা হইয়া অবাক হইয়া গিয়াছেন । দাড়িগণ উভয়কে ধরিয়া নীেকায় তুলিয়া তৎক্ষণাৎ নীেকা ছাড়িয়া দিল । সীতারাম ভীত হইয়া কহিল, “যাত্রার সময় কী অমঙ্গল !” একত্রিংশ পরিচ্ছেদ উদয়াদিত্যের নীেকা খাল অতিক্রম করিয়া নদীতে গিয়া পৌছিল, তখন সীতারাম নৌকা হইতে উদয়াদিত্যের তিনখানি পত্র একটি লোকের হাত দিয়া সীতারাম প্রাসাদে প্রেরণ করিয়াছিল বটে, কিন্তু সে চিঠি কয়খনি কাহারও হাতে দিতে তাহাকে গোপনে বিশেষরূপে নিষেধ করিয়াছিল। নীেকা হইতে প্রাসাদে ফিরিয়া আসিয়া সীতারাম সেই চিঠি কয়খনি ফিরাইয়া লইল । কেবল মহিষী ও বিভার