পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Wobr8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার সমস্ত উপায় সমস্ত উদ্দেশ্য একেবারে ভূমিসাৎ হইয়াছে। এখন রুক্মিণীর আর সেই নাই— রাজবাটীর যে-সকল ভূত্যেরা তাহার কাছে আসিত, তাহাদের সহিত ঝগড়া করিয়া তাহাদিগকে গালাগালি দিয়া ভাগাইয়া দিয়াছে। দেওয়ানজির জ্যেষ্ঠ পুত্রটি সেদিন পান চিবাইতে চিবাইতে তাহার সহিত রসিকতা করিতে আসিয়াছিল, রুক্মিণী তাহাকে ঝাটাইয়া তাড়াইয়াছে। এখন আর কেহ তাহার কাছে ঘোষিতে পারে না । পাড়ার সকলেই তাহাকে ভয় করে । সীতারাম কুটির হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ভাবিল, মঙ্গলা যুবরাজের পলায়ন-বৃত্তান্ত সমস্তই অবগত হইয়াছে ; অতএব ইহার দ্বারাই সব ফাস হইবে । সর্বনাশীকে গলা টিপিয়া মারিয়া আসিলাম না কেন । যাহা হউক, আমার আর যশোহরে একমুহূর্ত থাকা শ্রেয় নয় । আমি এখনই পালাই। সেই রাত্রেই সীতারাম সপরিবারে যশোহর ছাড়িয়া রায়গড়ে পলাইল । শেষরাত্রে মেঘ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল, আগুনও ক্রমে নিবিয়া গেল। যুবরাজের মৃত্যুর জনরব প্রতাপাদিত্যের কানো গেল । শুনিয়া তৎক্ষণাৎ প্রতাপাদিত্য বহির্দেশে তাহার সভাভবনে সিয়া বসিলেন । প্রহরীদের ডাকাইয়া আনিলেন, মন্ত্রী আসিল, আর দুই-একজন সভাসদ আসিল । একজন সাক্ষ্য দিল, যখন আগুন ধুধু করিয়া জ্বলিতেছিল, তখন সে যুবরাজকে জানালার মধ্য হইতে দেখিয়াছে। আর-কয়েকজন কহিল, তাহারা যুবরাজের চীৎকার শুনিতে পাইয়াছিল । আর-একজন যুবরাজের গৃহ হইতে তাহার গলিত দগ্ধ তলোয়ারের অবশিষ্টাংশ আনিয়া উপস্থিত করিল। প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুড়া কোথায় ?” রাজবাটী অনুসন্ধান করিয়া তাহাকে খুঁজিয়া পাইল না । কেহ কহিল, “যখন আগুন লাগিয়াছিল, তখন তিনিও কারাগারে ছিলেন ।” কেহ কহিল, “না, রাত্রেই তিনি সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, গৃহদাহে যুবরাজের মৃত্যু হইয়াছে ও তাহা শুনিয়াই তিনি তৎক্ষণাৎ যশোর ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন।” প্রতাপাদিত্য এইরূপে যখন সভায় বসিয়া সকলের সাক্ষ্য শুনিতেছেন, এমন সময়ে গৃহদ্বারে এক কলরব উঠিল । একজন স্ত্রীলোক ঘরে প্রবেশ করি চায়, কিন্তু প্রহরীরা তাহাকে নিষেধ করিতেছে । শুনিয়া প্রতাপাদিত্য তাহাকে ঘরে লইয়া আসিতে আদেশ করিলেন । একজন প্রহরী রুক্সিণীকে সঙ্গে করিয়া আনিল । রাজা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কী চাও ?” সে হাত নাড়িয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিল, “আমি আর-কিছু চাই না— তোমার ঐ প্রহরীদিগকে, সকলকে একে একে ছয় মাস গারদে পচাইয়া ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াও, এই আমি দেখিতে চাই । ওরা কি তোমাকে মানে না তোমাকে ভয় করে !” এই কথা শুনিয়া প্রহরীরা চারি দিক হইতে গোল করিয়া উঠিল । রুক্সিণী পিছন ফিরিয়া চোখ পাকাইয়া তীব্ৰ এক ধমক দিয়া কহিল, “চুপ করা মিনিসেরা । কাল যখন তোদের হাতে-পায়ে ধরিয়া, পই পাই করিয়া বলিলাম, ওগো তোমাদের যুবরাজ তোমাদের রায়গড়ের বুড়া রাজার সঙ্গে পালায়, তখন যে তোরা পোড়ারমুখোরা আমার কথায় কান দিলি নে ? রাজার বাড়ি চাকরি করা, তোমাদের বড়ো অহংকার হইয়াছে, তোমরা সাপের পাচ পা দেখিয়াছ । পিপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে ।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “যাহা যাহা ঘটিয়াছে সমস্ত বলে ।” রুক্সিণী কহিল, “বলিব আর কী । তোমাদের যুবরাজ কাল রাত্রে বুড়া রাজার সঙ্গে পলাইয়াছে!” প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঘরে কে আগুন দিয়াছে জান ?” রুক্সিণী কহিল, “আমি আর জানি না ! সেই যে তোমাদের সীতারাম ; তোমাদের যুবরাজের সঙ্গে যে তার বড়ো পিরিত, আর কেউ যেন তার কেউ নয় সীতারামই যেন তার সব । এ-সমস্ত সেই সীতারামের কাজ । বুড়া রাজা, সীতারাম আর তোমাদের যুবরাজ, এই তিনজনে মিলিয়া পরামর্শ করিয়া ইহা করিয়াছে, এই তোমাকে স্পষ্ট বলিলাম ।” প্রতাপাদিত্য অনেকক্ষণ ধরিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন । জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এ-সব কী করিয়া জানিতে পারিলে ?” রুক্সিণী কহিল, “সে কথায় কাজ কী গা ! আমার সঙ্গে লোক দাও, আমি স্বয়ং \O البتها