পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VbrV) রবীন্দ্র-রচনাবলী করিবেন না ? হা জগদীশ্বর, বুঝাইয়া বলিব কবে ? কবে। আবার দেখা হইবে ? উলটিয়া পালটিয়া বিভা ক্রমাগত এই কথাই ভাবিত । দিবানিশি তাহার মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা চাপিয়া ছিল । মহিষীৰ কথা শুনিয়া বিভার কী অপরিসীম আনন্দ হইল, তাহার মন হইতে কী ভয়ানক একটা গুরুভার তৎক্ষণাৎ দূর হইয়া গেল। লজ্জা-শরম দূর করিয়া হাসিয়া কাদিয়া সে তাহার মায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া কতক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার মা কঁদিতে লাগিলেন। বিভা যখন মনে করিল। তাহার স্বামী তাহাকে ভুল বুঝেন নাই, তাহার মনের কথা ঠিক বুঝিয়াছেন— তখন তাহার চক্ষে সমস্ত জগৎ ভালোবাসার উপর কতখানি বিশ্বাস, কতখানি আস্থা জন্মিল । সে মনে করিল, তাহার স্বামীর ভালোবাসা এ জগতে তাহার অটল আশ্রয় । সে যে এক বলিষ্ঠ মহাপুরুষের বিশাল স্কন্ধে তাহার ক্ষুদ্র সুকুমার লতাটির মতো বাহু জড়াইয়া নিৰ্ভয়ে অসীম বিশ্বাসে নির্ভর করিয়া রহিয়াছে, সে নির্ভর হইতে কিছুতেই সে বিচ্ছিন্ন হইবে না । বিভা প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিল । তাহার প্রাণ মেঘমুক্ত শরতের আকাশের মতো প্রসারিত, নির্মল হইয়া গেল । সে এখন তাহার ভাই সমর্যাদিত্যের সঙ্গে ছেলেমানুষের মতো কত মায়ের গৃহকার্যে সাহায্য করে । আগে যে তাহার একটি বাক্যহীন নিস্তব্ধ বিষগ্ন ছায়ার মতো ভাব ছিল, তাহা ঘুচিয়া গেছে— এখন তাহার প্রফুল্ল হৃদয়খানি পরিস্ফুট প্রভাতের ন্যায় তাহার সর্বাঙ্গে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে । আগেকার মতো সে সংকোচ, সে লজা, সে বিষাদ, সে অভিমান, সেই নীরব ভাব আর নাই ; সে এখন আনন্দভরে বিশ্বস্তভাবে মায়ের সহিত এত কথা বলে যে আগে হইলে বলিতে লজা করিত, ইচ্ছাই হইত না । মেয়ের এই আনন্দ দেখিয়া মায়ের অসীম স্নেহ উথলিয়া উঠিল । মনের ভিতরে ভিতরে একটা ভাবনা জাগিতেছে বটে, কিন্তু বিভার নিকট আভাসেও সে ভাবনা কখনো প্রকাশ করেন নাই। মা হইয়া আবার কোন প্ৰাণে বিভার সেই বিমল প্রশান্ত হাসিটুকু এক তিল মলিন করিবেন। এইজন্য মেয়েটি প্রতিদিন চোখের সামনে হাসিয়া খেলিয়া বেড়ায়, মা হাস্যমুখে অপরিতৃপ্ত নয়নে তাহাই দেখেন । মহিষীর মনের ভিতর নাকি একটা ভয়, একটা সন্দেহ বর্তমান ছিল, তারই জন্য আজ কাল করিয়া এ-পর্যন্ত বিভাকে আর প্রাণ ধরিয়া শ্বশুরালয়ে পাঠাইতে পারিতেছেন না । দুই-এক সপ্তাহ চলিয়া গেল, উদয়াদিত্যের বিষয়ে সকলেই একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছেন । কেবল বিভার সম্বন্ধে যে কী করিবেন, মহিষী এখনো তাহার একটা স্থির করিতে পারিতেছেন না। এমন আরো কিছুদিন গেল। যতই বিলম্ব হইতেছে, ততই বিভার অধীরতা বাড়িতেছে। বিভা মনে করিতেছে, যতই বিলম্ব হইতেছে, ততই সে যেন তাহার স্বামীর নিকট অপরাধী হইতেছে । তিনি যখন ডাকিয়া পঠাইয়াছেন, তখন আর কিসের জন্য বিলম্ব করা । একবার তিনি মার্জনা করিয়াছেন, আবার— । কয়েক দিন বিভা আর-কিছু বলিল না, অবশেষে একদিন আর থাকিতে পারিল না ; মায়ের কাছে গিয়া মায়ের গলা ধরিয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বিভা কহিল, “মা ।” ঐ কথাতেই তাহার মা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন, বিভাকে বুকে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “কী বাছা।” বিভা কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অবশেষে কহিল, “মা, তুই আমাকে কবে পাঠাইবি মা।” বলিতে বলিতে বিভার মুখ কান লাল হইয়া উঠিল। মা ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় পাঠাইব বিভু।” বিভা মিনতিস্বরে কহিল, “বলো-না মা ।” মহিষী৷ কহিলেন, “আর কিছুদিন সবুর করো বাছা । শীঘ্রই পাঠাইব ।” বলিতে বলিতে র্তাহার চক্ষে জল ऊनिव्न । 海