পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \\pbrዓ ত্ৰিয়ন্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ বহুদিনের পর উদয়াদিত রায়গড়ে আসিলেন, কিন্তু আগেকার মতো তেমন আনন্দ আর পাইলেন না । মনের মধ্যে একটা ভাবনা চাপিয়া ছিল, তাই কিছুই তেমন ভালো লাগিল না । তিনি ভাবিতেছিলেন, দাদামহাশয় যে কাজ করিয়াছেন, তাহার যে কী হইবে তাহার ঠিকানা নাই, পিতা যে সহজে নিষ্কৃতি দিবেন। এমন তো বোধ হয় না । আমার কী কুক্ষণেই জন্ম হইয়াছিল। তিনি বসন্ত রায়ের কাছে গিয়া কহিলেন, “দাদামহাশয়, আমি যাই, যশোহরে ফিরিয়া যাই ।” প্রথম প্রথম বসন্ত রায় গান গাহিয়া হাসিয়া এ কথা উড়াইয়া দিলেন ; তিনি গাহিলেন, আর কি আমি ছাড়ব তোরে । মন দিয়ে মন নাই বা পেলেম জোর করে রাখিব ধরে । শূন্য করে হৃদয়-পুরী প্ৰাণ যদি করিলে চুরি তুমিই তবে থাকো সেথায় শূন্য হৃদয় পূর্ণ করে । অবশেষে উদয়াদিত্য বার বার কহিলে পর বসন্ত রায়ের মনে আঘাত লাগিল, তিনি গান বন্ধ করিয়া বিষন্নমুখে কহিলেন, “কেন দাদা, আমি কাছে থাকিলে তোর কিসের অসুখ ?” উদয়াদিত্য আর কিছু বলিতে পারিলেন না । উদয়াদিত্যকে উন্মনা দেখিয়া বসন্ত রায় তাহাকে সুখী করিবার জন্য দিনরাত প্ৰাণপণে চেষ্টা করিতেন । সেতার বাজাইতেন, গান গাহিতেন, সঙ্গে করিয়া লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেন, উদয়াদিত্যের জন্য প্রায় তাহার রাজকাৰ্য বন্ধ হইল । বসন্ত রায়ের ভয় পাছে উদয়াদিত্যকে না। রাখিতে পারেন, পাছে উদয়াদিত্য আবার যশোহরে চলিয়া যান । দিনরাত তাহাকে চোখে চোখে রাখেন, তাহাকে বলেন, "দাদা, তোকে আর সে পাষাণহৃদয়ের দেশে যাইতে দিব না ।” দিনকতক থাকিতে থাকিতে উদয়াদিত্যের মনের ভাবনা অনেকটা শিথিল হইয়া আসিল । অনেকদিনের পর স্বাধীনতা লাভ করিয়া, সংকীর্ণপ্ৰসর পাষাণময় চারিটি কারাভিত্তি হইতে মুক্ত হইয়া বসন্ত রায়ের কোমল হৃদয়ের মধ্যে তাহার অসীম মেহের মধ্যে বাস করিতেছেন । অনেক দিনের পর চারি দিকে গাছপালা দেখিতেছেন, আকাশ দেখিতেছেন, দিগদিগন্তে পরিব্যাপ্ত উন্মুক্ত উষার আলো দেখিতেছেন, পাখির গান শুনিতেছেন, দূর দিগন্ত হইতে হু হু করিয়া সর্বাঙ্গে বাতাস লাগিতেছে, রাত্রি হইলে সমস্ত আকাশময় তারা দেখিতে পান, জ্যোৎস্নার প্রবাহের মধ্যে ডুবিয়া যান, ঘুমন্ত স্তব্ধতার প্ৰাণের মধ্যে বিরাজ করিতে থাকেন । যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন, যাহা ইচ্ছা করিতে পারেন, কিছুতেই আর বাধা নাই। ছেলেবেলা যে-সকল প্ৰজারা উদয়াদিত্যকে চিনিত, তাহারা দূর-দূরান্তর হইতে উদয়াদিত্যকে দেখিবার জন্য আসিল । গঙ্গাধর আসিল, ফটিক আসিল, হবিচাচা ও করিমউল্লা আসিল, মথুর তাহার তিনটি ছেলে সঙ্গে করিয়া আসিল, পরান ও হরি দুই ভাই আসিল, শীতল সর্দার খৈলা দেখাইবার জন্য পাচজন লাঠিয়াল সঙ্গে লইয়া আসিল । প্রত্যহ যুবরাজের কাছে প্ৰজারা আসিতে লাগিল। যুবরাজ তাঁহাদের কত কী কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। এখনাে যে উদয়াদিত্য তাহাদিগকে ভোলেন নাই তাহা দেখিয়া প্ৰজারা অত্যন্ত আনন্দিত ও বিস্মিত হইল।। মথুর কহিল, "মহারাজ, আপনি যে মাসে রায়গড়ে আসিয়াছিলেন সেই মাসে আমার এই ছেলেটি জন্মায়, আপনি দেখিয়া গিয়াছিলেন, তার পরে আপনার আশীর্বাদে আমার আরো দুটি সন্তান জন্মিয়াছে।” বলিয়া সে তাহার তিন ছেলেকে যুবরাজের কাছে আনিয়া কহিল, “প্ৰণাম করো।” তাহারা ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিল। পরান আসিয়া কহিল, “এখান হইতে যশোর যাইবার সময় হুজুর যে নীেকায় গিয়াছিলেন,