পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট Wりぬぐ) করিতেছে— যুবরাজ একদৃষ্টি সম্মুখে চাহিয়া সুদূরপ্রসারিত শুভ্র বালির চড়ার দিকে চাহিয়া কেবলই ভাবিতে লাগিলেন। প্রত্যুষে মাঝিরা জাগিয়া উঠিল, নীেকা খুলিয়া দিল, উষার বাতাস বহিল, পূর্ব দিক বাঙা হইয়া উঠিল, যুবরাজ ভাবিতে লাগিলেন । তৃতীয় দিবসে যুবরাজের দুই চক্ষু ভাসিয়া হু হু করিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল— হাতের উপর মাথা রাখিয়া জলের দিকে চাহিয়া রহিলেন, আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন । নীেকা চলিতে লাগিল— তীরে গাছপালাগুলি মেঘের মতো চোখের উপর দিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল, চোখ দিয়া সহস্র ধারায় অশ্রু পড়িতে লাগিল । অনেকক্ষণের পর অবসর “যুবরাজ, কী ভাবিতেছেন।” যুবরাজ চমকিয়া উঠিলেন, অনেকক্ষণ স্তব্ধভাবে অবাক হইয়া মুক্তিয়ারের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন । মুক্তিয়ারের মুখে মমতার ভাব দেখিয়া সহসা রুদ্ধ প্ৰাণ খুলিয়া যুবরাজ বলিয়া উঠিলেন, “ভাবিতেছি, পৃথিবীতে জন্মাইয়া আমি কী করিলাম। আমার জন্য কী সর্বনাশই হইল। হে বিধাতা, যাহারা দুর্বল এ পৃথিবীতে তাহারা কেন জন্মায় ? যাহারা নিজের বলে সংসারে দাড়াইতে পারে না, যাহারা পদে পদে পরকে জড়াইয়া ধরে, তাহাদের দ্বারা পৃথিবীর কী উপকার হয় ? তাহারা যাহাকে ধরে, তাহাকেই ডুবায়, পৃথিবীর সকল কাজে বাধা দেয়।— নিজেও দাড়াইতে পারে না, আর-সকলকেও ভারাক্রান্ত করে । আমি একজন দুর্বল ভীরু, ঈশ্বর আমাকেই বঁাচাইলেন, আরা যাহারা সংসারের আনন্দ ছিল, সংসারের ভরসা ছিল- আমার জন্য তাহদেরই বিনাশ করিলেন । আর না, এ সংসার হইতে আমি বিদায় লইলাম ।” উদয়াদিত্য বন্দিভাবে প্রতাপাদিত্যের সম্মুখে আনীত হইলেন । প্রতাপাদিত্য র্তাহাকে অন্তঃপুরের কক্ষে লইয়া গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলেন । প্রতাপাদিত্যের কাছে আসিতেই উদয়াদিত্যের শরীর যেন শিহরিয়া উঠিল, অনিবার্য ঘূণায় তাহার সর্ব শরীরের মাংস যেন কুঞ্চিত হইয়া আসিল— তিনি পিতার মুখের দিকে আর চাহিতে পারিলেন না । প্রতাপাদিত্য গভীর স্বরে কহিলেন, “কোন শাস্তি তোমার উপযুক্ত ?” উদয়াদিত্য অবিচলিত ভাবে কহিলেন, “আপনি যাহা আদেশ করেন ।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “তুমি আমার এ রাজ্যের যোগ্য নহ।” উদয়াদিত্য কহিলেন, “না মহারাজ, আমি যোগ্য নাহি । আমি আপনার রাজ্য চাহি না । আপনার সিংহাসন হইতে আমাকে অব্যাহতি দিন, এই ভিক্ষা ।” প্রতাপাদিত্যও তাঁহাই চান, তিনি কহিলেন, “তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা যে সত্যই তোমার হৃদয়ের ভাব তাহা কী করিয়া জানিব ?” জন্য কখনো মিথ্যা কথা বলি নাই। বিশ্বাস না করেন যদি, আজ আমি মা কালীর চরণ স্পর্শ করিয়া শপথ করিব— আপনার রাজ্যের এক সূচ্যগ্ৰভূমিও আমি কখনাে শাসন করিব না। সমর্যাদিত্যই আপনার রাজ্যের উত্তরাধিকারী ।” প্রতাপাদিত্য সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “তুমি তবে কী চাও ?” উদয়াদিত্য কহিলেন, “মহারাজ, আমি আর কিছুই চাই না, কেবল আমাকে পিঞ্জরাবদ্ধ পশুর মতো গারদে পুরিয়া রাখিবেন না। আমাকে পরিত্যাগ করুন, আমি এখনই কাশী চলিয়া যাই । আর-একটি ভিক্ষা— আমাকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিন। আমি সেখানে দাদামহাশয়ের নামে এক অতিথিশালা ও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিব।” সেইদিনই উদয়াদিত্য মন্দিরে গিয়া প্রতাপাদিত্যের সম্মুখে শপথ করিয়া কহিলেন, “মা কালী, তুমি সাক্ষী থাকো, তোমার পা ছুইয়া আমি শপথ করিতেছি— যতদিন আমি বঁচিয়া থাকিব, যশোহরের মহারাজের রাজ্যের এক তিলও আমি আমার বলিয়া গ্রহণ করিব না। যশোহরের সিংহাসনে আমি বসিব না, যশোহরের রাজদণ্ড আমি স্পর্শও করিব না। যদি কখনো করি, তবে এই দাদামহাশয়ের