পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

করিলেন । শোক বিপদ অত্যাচারের রঙ্গভূমি পশ্চাতে পড়িয়া রহিল— জীবনের কারাগার পশ্চাতে পড়িয়া বহিল। উদয়াদিত্য মনে করিলেন এ বাড়িতে এ জীবনে আর প্রবেশ করিব না। একবার পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন। দেখিলেন রক্তপিপাসু কঠোর হৃদয় রাজবাটী আকাশের মধ্যে মাথা তুলিয়া দৈত্যের ন্যায় দাড়াইয়া আছে। পশ্চাতে ষড়যন্ত্র, যথেচ্ছাচারিতা, রক্তলালসা, দুর্বলের পীড়ন, আসহায়ের অশ্রুজল পড়িয়া রহিল, সম্মুখে অনন্ত স্বাধীনতা, প্রকৃতির অকলঙ্ক সৌন্দর্য, হৃদয়ের স্বাভাবিক স্নেহমমতা তাহাকে আলিঙ্গন করিবার জন্য দুই হাত বাড়াইয়া দিল। তখন সবে প্ৰভাত হইয়াছে। নদীর পূর্ব পারে বন্যান্তের মধ্য হইতে কিরণের ছটা উর্ধবশিখা হইয়া উঠিয়াছে। গাছপালার মাথার উপরে সোনার আভা পড়িয়াছে। লোকজন জাগিয়া উঠিয়াছে। মাঝিরা আনন্দে গান গাহিতে গাহিতে পাল তুলিয়া নীেকা খুলিয়া দিয়াছে। প্রকৃতির এই বিমল প্রশান্ত পবিত্র প্রভাত-মুখশ্ৰী দেখিয়া উদয়াদিত্যের প্রাণ পাখিদের সহিত স্বাধীনতার গান গাহিয়া উঠিল । মনে মনে কহিলেন, “জন্ম জন্ম যেন প্রকৃতির এই বিমল শ্যামল ভাবের মধ্যে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিতে পারি, আর সরল প্রাণীদের সহিত একত্রে বাস করিতে পারি ।” নীেকা ছাড়িয়া দিল । মাঝিদের গান ও জলের কল্লোল শুনিতে শুনিতে উভয়ে অগ্রসর হইলেন । বিভার প্রশান্ত হৃদয়ে আনন্দের উষালোক বিরাজ করিতেছিল, তাহার মুখে চােখে অরুণের দীপ্তি। সে যেন এতদিনের পর একটা দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিয়া জগতের মুখ দেখিয়া আশ্বস্ত হইল। বিভা যাইতেছে । কাহার কাছে যাইতেছে ? কে তাহাকে ডাকিতেছে ? অনন্ত অচল প্ৰেম তাহাকে ডাকিয়াছে’- বিভা ছোটো পাখিটির মতো ডানা ঢাকিয়া সেই কোমল প্রেমের স্তরের মধ্যে আরামে বিশ্বস্ত হৃদয়ে লুকাইয়া থাকিবে । জগতের চারি দিকে সে আজ মেহের সমুদ্র দেখিতে পাইতেছে। উদয়াদিত্য বিভাকে কাছে ডাকিয়া জলের কল্লোলের ন্যায় মৃদু স্বরে তাঁহাকে কত কী কাহিনী শুনাইতে লাগিলেন । যাহা শুনিল, বিভার তাহাই ভালো লাগিল । রামচন্দ্র রায়ের রাজ্যের মধ্যে নীেকা প্রবেশ করিল। চারি দিক দেখিয়া বিভার মনে এক অভূতপূর্ব আনন্দের উদয় হইল। কী সুন্দর শোভা । কুটিরগুলি দেখিয়া লোকজনদের দেখিয়া বিভার মনে হইল সকলে কী সুখেই আছে। বিভার ইচ্ছা হইতে লাগিল, প্ৰজাদিগকে কাছে ডাকিয় তাহাদের রাজার কথা একবার জিজ্ঞাসা করে । প্ৰজাদিগকে দেখিয়া তাহার মনে কেমন একপ্রকার অপূর্ব মেহের উদয় হইল । যাহাকে দেখিল সকলকেই তাহার ভালো লাগিল । মাঝে মাঝে দুই-একজন দরিদ্র দেখিতে পাইল ; বিভা মনে মনে কহিল, ‘আহা, ইহার এমন দশা কেন ? আমি অন্তঃপুরে গিয়া ইহাকে ডাকাইয়া পাঠাইব । যাহাতে ইহার দুঃখ মোচন হয়, তাহাই করিব।” সকলই তাহার। আপনার বলিয়া মনে হইল। এ-রাজ্যে যে দুঃখ-দারিদ্র্য আছে, ইহা তাহার প্রাণে সহিল না। বিভার ইচ্ছা করিতে লাগিল, প্রজারা তাহার কাছে আসিয়া একবার তাহাকে মা বলিয়া ডাকে, তাহার কাছে নিজের নিজের দুঃখ নিবেদন করে ও সে সেই দুঃখ দূর করিয়া দেয়। রাজধানীর নিকটবর্তী গ্রামে উদয়াদিত্য নীেকা লাগাইলেন । তিনি স্থির করিয়াছেন, রাজবাটীতে তাহদের আগমন-বার্তা বলিয়া পাঠাইবেন ও তাহারা অভ্যর্থনা করিয়া তাহাদের লইয়া যাইবে । যখন নীেকা লাগাইলেন, তখন বিকাল হইয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য মনে করিলেন, কাল প্রাতে লোক পাঠানো যাইবে । বিভার মনের ইচ্ছা। আজই সংবাদ দেওয়া হয় |