পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী হাস্য করিয়া উঠিলেন। তিনি ভাবিলেন, বিভাকে এখন মমতা দেখাইলে পাছে উপহাসাম্পদ হইতে হয় । বিভার মাথায় একেবারে সহস্ৰ বজ্ৰাঘাত হইল, সে লজ্জায় একেবারে মরিয়া গেল। চােখ বুজিয়া মনে মনে কহিল, মা গো, বসুন্ধরা, তুমি দ্বিধা হও । কাতর হইয়া চারি দিকে চাহিল, রামমোহনের মুখের দিকে একবার অসহায় দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল । রামমোহন কঁাপিতে কঁাপিতে কহিল, “মহারাজ, আমি বেয়াদবি করিলাম । তোমার মহিষীকে— আমার মা-ঠাকরুনকে বেটা অপমান করিল- উহার হইয়াছে কী, আমি উহার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া শহর হইতে বাহির করিয়া দিব, তবে আমার নাম রামমোহন ৷” রাজা রামমোহনকে ধমক দিয়া কহিলেন, “কে আমার মহিষী ? আমি উহাকে চিনি না ।” বিভার মুখ নীল হইয়া গেল, সে মুখে আঁচল চাপিয়া ধরিল, থর থর করিয়া তাহার সর্বাঙ্গ। কঁাপিতে লাগিল, অবশেষে কঁাপিতে কঁাপিতে বিভা মুছিতা হইয়া ভূমিতে পড়িল । তখন রামমোহন জোড়হন্তে রাজাকে কহিল, “মহারাজ, আজ চারপুরুষে তোমার বংশে আমরা চাকরি করিয়া আসিতেছি। বাল্যকাল হইতে তোমাকে পালন করিয়াছি। আজ তুমি আমার মা-ঠাকরুনকে অপমান করিলে, তোমার রাজ্যলক্ষ্মীকে দূর করিয়া দিলে, আজ আমিও তোমার চাকরি ছাড়িয়া দিয়া চলিলাম। আমার মা-ঠাকরুনের সেবা করিয়া জীবন কাটাইব । ভিক্ষা করিয়া খাইব, তবুও এ রাজবাটীর ছায়া মাড়াইব না ।” বলিয়া রামমোহন রাজাকে প্ৰণাম করিল ও বিভাকে কহিল, “আয় মা, আয় । এখান হইতে শীঘ্র চলিয়া আয় । আর এক মুহুৰ্তও এখানে থাকা নয়।” বলিয়া বিভাকে ধরিয়া তুলিয়া আনিল । দ্বারের নিকট অনেকগুলি শিবিকা ছিল, তাহার মধ্যে একটিতে হতজ্ঞান অবসন্ন বিভাকে তুলিয়া নীেকায় ফিরিয়া আসিল । বিভা উদয়াদিত্যের সহিত কাশী চলিয়া গেল । সেইখানে দানধ্যান, দেবসেবা ও তাহার ভ্রাতার সেবায় জীবন কাটাইতে লাগিল । রামমোহন যতদিন বাচিয়া ছিল, তাহাদের সঙ্গে ছিল । সীতারামও সপরিবারে কাশীতে আসিয়া উদয়াদিত্যের আশ্রয় লইল । চন্দ্ৰদ্বীপের যে হাটের সম্মুখে বিভার নীেকা লাগিয়াছিল, অদ্যাপি তাহার নাম রহিয়াছে— “বউ-ঠাকুরানীর হাট ।”