পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Օ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মন্দিরকে বলিত পালু, আর সে কড়াইকে বলাই বলিত কিনা জানি না। কিন্তু কড়িকে বলিত ঘয়ি, সুতরাং তাতার এরূপ বিচিত্র উচ্চারণ শুনিয়া তাহার যে অত্যন্ত হাসি পাইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী । তাতা সম্বন্ধে নানা ঘটনা সে রাজাকে বলিতে লাগিল । একবার একজন বুড়োমানুষ কম্বল জড়াইয়া আসিয়াছিল, তাতা তাহাকে ভালুক বলিয়াছিল, এমনি তাতার মন্দবুদ্ধি। আর-একবার তাত গাছের আতাফলগুলিকে পাখি মনে করিয়া মোটা মোটা ছোটাে দুটি হাতে তালি দিয়া তাহাদিগকে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিল। তাতা যে হাসির চেয়ে অনেক ছেলেমানুষ, ইহা তাতার দিদি বিস্তর উদাহরণ-দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণ করিয়া দিল । তাতা নিজের বুদ্ধির পরিচয়ের কথা সম্পূর্ণ অবিচলিতচিত্তে শুনিতেছিল, যতটুকু বুঝিতে পারিল তাহাতে ক্ষোভের কারণ কিছুই দেখিতে পাইল না । এইরূপে সেদিনকার সকালে ফুল তোলা শেষ হইল । ছোটাে মেয়েটির আঁচল ভরিয়া যখন ফুল দিলেন তখন রাজার মনে হইল, যেন তাহার পূজা শেষ হইল ; এই দুইটি সরল প্ৰাণের মেহের দৃশ্য দেখিয়া, এই পবিত্র হৃদয়ের আশ মিটাইয়া ফুল তুলিয়া দিয়া, তাহার যেন দেবপূজার কাজ হইল । তাহার পরদিন হইতে ঘুম ভাঙিলে সূর্য উঠিলেও রাজার প্রভাত হইত না, ছোটাে দুটি ভাইবোনের মুখ দেখিলে তবে তাহার প্রভাত হইত। প্রতিদিন তাহাদিগকে ফুল তুলিয়া দিয়া তবে তিনি স্নান করিতেন ; দুই ভাইবোনে ঘাটে বসিয়া তাহার স্নান দেখিত । যেদিন সকালে এই দুটি ছেলেমেয়ে না। আসিত, সেদিন তাহার সন্ধ্যা-আহ্নিক যেন সম্পূর্ণ হইত না । হাসি ও তাতার বাপ মা কেহ নাই। কেবল একটি কাকা আছে। কাকার নাম কেদারেশ্বর । এই দুটি ছেলেমেয়েই তাহার জীবনের একমাত্ৰ সুখ ও সম্বল । এক বৎসর কাটিয়া গেল । তাত এখন মন্দির বলিতে পারে, কিন্তু এখনো কড়াই বলিতে বলাই বলে । অধিক কথা সে কয় না । গোমতী নদীর ধারে নাগকেশর গাছের তলায় পা ছড়াইয়া তাহার দিদি তাহাকে যে-কোনো গল্পই করিত, সে তাহাই ড্যাবাড্যাবা চোখে অবাক হইয়া শুনিত । সে গল্পের কোনো মাথামুণ্ড ছিল না ; কিন্তু সে যে কী বুঝিত সেই জানে ; গল্প শুনিয়া সেই গাছের তলায়, সেই সূর্যের আলোতে, সেই মুক্ত সমীরণে, একটি ছােটাে ছেলের ছোটাে হৃদয়টুকুতে যে কত কথা কত ছবি উঠিত তাহা আমরা কী জানি। তাতা আর-কোনাে ছেলের সঙ্গে খেলা করিত না, কেবল তাহার দিদির সঙ্গে ছায়ার মতো বেড়াইত । আষাঢ় মাস। সকাল হইতে ঘন মেঘ করিয়া রহিয়াছে। এখনো বৃষ্টি পড়ে নাই, কিন্তু বাদলা হইবার উপক্রম দেখা যাইতেছে। দূর দেশের বৃষ্টির কণা বহিয়া শীতল বাতাস বহিতেছে। গোমতী নদীর জলে এবং গোমতী নদীর উভয় পারের অরণ্যে অন্ধকার আকাশের ছায়া পড়িয়াছে। কাল রাত্রে অমাবস্যা ছিল, কাল ভুবনেশ্বরীর পূজা হইয়া গিয়াছে। যথাসময়ে হাসি ও তাতার হাত ধরিয়া রাজা স্নান করিতে আসিয়াছেন । একটি রক্তস্রোতের রেখা শ্বেত প্ৰস্তরের ঘাটের সোপান বাহিয়া জলে গিয়া শেষ হইয়াছে। কাল রাত্রে যে একশো-এক মহিষ বলি হইয়াছে তাহারই রক্ত । হাসি সেই রক্তের রেখা দেখিয়া সহসা একপ্রকার সংকোচে সরিয়া গিয়া রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল, “এ কিসের দাগ বাবা ।” রাজা বলিলেন, “রক্তের দাগ মা !” সে কহিল, “এত রক্ত কেন !” এমন একপ্রকার কাতর স্বরে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করিল, “এত রক্ত কেন যে, রাজারও হৃদয়ের মধ্যে ক্রমাগত এই প্রশ্ন উঠিতে লাগিল, “এত রক্ত কেন ?” তিনি সহসা শিহরিয়া উঠিলেন । বহুদিন ধরিয়া প্ৰতিবৎসর রক্তের স্রোত দেখিয়া আসিতেছেন, একটি ছোটে মেয়ের প্রশ্ন শুনিয়া তাহার মনে উদিত হইতে লাগিল, “এত রক্ত কেন ? তিনি উত্তর দিতে ভুলিয়া