পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

° のV2 রবীন্দ্র-রচনাবলী হাসি চােখ বুজিল । চক্ষু আর খুলিল না। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় রাজার কোলে হাসির মৃত্যু হইল। হাসিকে যখন চিরদিনের জন্য কুটির হইতে লইয়া গেল, তখন তাতা অজ্ঞান হইয়া ঘুমাইতেছিল। সে যদি জানিতে পাইত, তবে সেও বুঝি দিদির সঙ্গে সঙ্গে ছোটাে ছায়াটির মতো চলিয়া যাইত । তৃতীয় পরিচ্ছেদ পুরোহিতের নাম রঘুপতি । এ দেশে পুরোহিতকে চােন্তাই বলিয়া থাকে। ভুবনেশ্বরী দেবীর পূজার চৌদ্দ দিন পরে গভীর রাত্রে চতুর্দশ দেবতার এক পূজা হয়। এই পূজার সময় এক দিন দুই রাত্রি কেহ ঘরের বাহির হইতে পারে না, রাজাও না । রাজা যদি বাহির হন, তবে চোস্তাইয়ের নিকটে তাহাকে অর্থদণ্ড দিতে হয়। প্রবাদ আছে, এই পূজার রাত্রে মন্দিরে নরবলি হয়। এই পূজা উপলক্ষে সর্বপ্রথমে যে-সকল পশুবলি হয়, তাহা রাজবাড়ির দান বলিয়া গৃহীত হয়। এই বলির পশু গ্রহণ করিবার জনা চােস্তাই রাজসমীপে আসিয়াছেন । পূজার আর বারো দিন বাকি আছে। রাজা বলিলেন, “এ বৎসর হইতে মন্দিরে জীববলি আর হইবে না ।” সভাসুদ্ধ লোক অবাক হইয়া গেল । রাজভ্ৰাতা নক্ষত্ররায়ের মাথার চুল পর্যন্ত দাড়াইয়া উঠিল । চােস্তাই রঘুপতি বলিলেন, “আমি এ কি স্বপ্ন দেখিতেছি!” রাজা বলিলেন, “না ঠাকুর, এতদিন আমরা স্বপ্ন দেখিতেছিলাম, আজ আমাদের চেতনা হইয়াছে ; একটি বালিকার মূর্তি ধরিয়া মা আমাকে দেখা দিয়াছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, করুণাময়ী জননী হইয়া মা তাহার জীবের রক্ত আর দেখিতে পারেন না ।” রঘুপতি কহিলেন, “মা তবে এতদিন ধরিয়া জীবের রক্ত পান করিয়া আসিতেছেন কী করিয়া ?” রাজা কহিলেন, “না, পান করেন নাই । তোমরা যখন রক্তপাত করিতে তখন তিনি মুখ ফিরাইয়া থাকিতেন ।” রঘুপতি বলিলেন, “মহারাজ, রাজকাৰ্য আপনি ভালো বুঝেন সন্দেহ নাই, কিন্তু পূজা সম্বন্ধে আপনি কিছুই জানেন না। দেবীর যদি কিছুতে অসন্তোষ হইত, আমিই আগে জানিতে পারিতাম।” নক্ষত্ররায় অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “হা, এ ঠিক কথা । দেবীর যদি কিছুতে অসন্তোষ হইত, ঠাকুরমহাশয়ই আগে জানিতে পাইতেন।” রাজা বলিলেন, “হৃদয় যার কঠিন হইয়া গিয়াছে, দেবীর কথা সে শুনিতে পায় না ।” নক্ষত্ররায় পুরোহিতের মুখের দিকে চাহিলেন— ভাবটা এই যে, এ কথার একটা উত্তর দেওয়া আবশ্যক। রঘুপতি আগুন হইয়া উঠিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আপনি পাষণ্ড নাস্তিকের মতো কথা কহিতেছেন ।” নক্ষত্ররায় মৃদু প্ৰতিধ্বনির মতো বলিলেন, “হা, নাস্তিকের মতো কথা কহিতেছেন।” আপনি মিথ্যা সময় নষ্ট করিতেছেন । মন্দিরের কাজ বহিয়া যাইতেছে, আপনি মন্দিরে যান । যাইবার সময় পথে প্রচার করিয়া দিবেন যে, আমার রাজ্যে যে ব্যক্তি দেবতার নিকট জীববলি দিবে তাহার নির্বাসনদণ্ড হইবে ।” তখন রঘুপতি কঁাপিতে কঁাপিতে উঠিয়া দাড়াইয়া পইতা স্পর্শ করিয়া বলিলেন, “তবে তুমি উচ্ছন্ন Rig ” চারি দিক হইতে হা-হা করিয়া সভাসদগণ পুরোহিতের উপর গিয়া পড়িলেন। রাজা ইঙ্গিতে সকলকে নিষেধ করিলেন, সকলে সরিয়া দাড়াইলেন । রঘুপতি বলিতে লাগিলেন, “তুমি রাজা, তুমি ইচ্ছা করিলে প্ৰজার সর্বস্ব হরণ করিতে পারো, তাই বলিয়া তুমি মায়ের বলি হরণ করিবে ! বটে ! কী তোমার সাধ্য ! আমি রঘুপতি মায়ের সেবক থাকিতে কেমন তুমি পূজার ব্যাঘাত করা দেখিব ।”