পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aのbr V. রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্মুখে বসিয়া তিনি কথা কহিতেন, তাহার একলা বোধ হইত না । তাহার আরো সঙ্গী ছিল। মন্দিরের বাগানের অনেকগুলি গাছকে তিনি নিজের হাতে মানুষ করিয়াছেন । তাহার চারি দিকে প্রতিদিন র্তাহার গাছগুলি বাড়িতেছে, লতাগুলি জড়াইতেছে, শাখা পুষ্পিত হইতেছে, ছায়া বিস্তৃত হইতেছে শ্যামল বল্লরীর পল্লবস্তবকে যৌবনগর্বে নিকুঞ্জ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু জয়সিংহের এ-সকল প্ৰাণের কথা, ভালোবাসার কথা, বড়ো কেহ একটা জানিত না ; তাহার বিপুল বল ও সাহসের জন্যই তিনি বিখ্যাত ছিলেন । মন্দিরের কাজকর্ম শেষ করিয়া জয়সিংহ তাহার কুটিরের দ্বারে বসিয়া আছেন । সম্মুখে মন্দিরের কানন । বিকাল হইয়া আসিয়াছে। অত্যন্ত ঘন মেঘ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে । নববর্ষার জলে জয়সিংহের গাছগুলি সান করিতেছে, বৃষ্টিবিন্দুর নৃত্যে পাতায় পাতায় উৎসব পড়িয়া গিয়াছে, বর্ষািজলের ছোটো ছোটাে শত শত প্রবাহ ঘোলা হইয়া, কলকল করিয়া গোমতী নদীতে গিয়া পড়িতেছে- জয়সিংহ পরমানন্দে তাহার কাননের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন । চারি দিকে মেঘের স্নিগ্ধ অন্ধকার, বনের ছায়া, ঘনপল্লবের শ্যামশ্ৰী, ভেকের কোলাহল, বৃষ্টির অবিশ্রাম ঝরঝর শব্দ— কাননের মধ্যে এইরূপ নববর্ষার ঘোরঘিটা দেখিয়া তাহার প্রাণ জুড়াইয়া যাইতেছে। ভিজিতে ভিজিতে রঘুপতি আসিয়া উপস্থিত হইলেন । জয়সিংহ তাড়াতাড়ি উঠিয়া পা ধুইবার জল ও শুকনো কাপড় আনিয়া দিলেন । রঘুপতি বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “তোমাকে কাপড় আনিতে কে বলিল ?” বলিয়া কাপড়গুলা লইয়া ঘরের মধ্যে ফেলিয়া দিলেন । জয়সিংহ পা ধুইবার জল লইয়া অগ্রসর হইলেন । রঘুপতি বিরক্তির স্বরে কহিলেন, “থাক থাক, তোমার ও জল রাখিয়া দাও ।” বলিয়া পা দিয়া জলের ঘটি ঠেলিয়া ফেলিলেন । জয়সিংহ সহসা এরূপ ব্যবহারের কারণ বুঝিতে না পারিয়া অবাক হইলেন— কাপড় ভূমি হইতে তুলিয়া যথাস্থানে রাখিতে উদ্যত হইলেন— রঘুপতি পুনশ্চ বিরক্তভাবে কহিলেন, “থাক থাক, ও কাপড়ে তোমার হাত দিতে হইবে না ।” বলিয়া নিজে গিয়া কাপড় ছাড়িয়া আসিলেন । জল লইয়া পা ধুইলেন । জয়সিংহ ধীরে ধীরে কহিলেন, “প্ৰভু, আমি কি কোনো অপরাধ করিয়াছি ?” রঘুপতি কিঞ্চিৎ উগ্রস্বরে কহিলেন, “কে বলিতেছে যে তুমি অপরাধ করিয়াছ ?” জয়সিংহ ব্যথিত হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন । রঘুপতি অস্থিরভাবে কুটিরের দাওয়ায় বেড়াইতে লাগিলেন । এইরূপে রাত্রি অনেক হইল ; ক্ৰমাগত বৃষ্টি পড়িতে লাগিল । অবশেষে রঘুপতি জয়সিংহের পিঠে হাত দিয়া কোমলস্বরে কহিলেন, “বৎস, শয়ন করিতে যাও, রাত্রি অনেক হইল।” জয়সিংহ রঘুপতির মেহের স্বরে বিচলিত হইয়া কহিলেন, “প্ৰভু আগে শয়ন করিতে যান, তার পরে আমি যাইব ।” রঘুপতি কহিলেন, “আমার বিলম্ব আছে। দেখো পুত্ৰ, তোমার প্রতি আমি আজ কঠোর ব্যবহার করিয়াছি, কিছু মনে করিয়ো না । আমার মন ভালো ছিল না। সবিশেষ বৃত্তান্ত তোমাকে কাল প্ৰভাতে বলিব । আজ তুমি শয়ন করোগে ।” জয়সিংহ কহিলেন, “ যে আজ্ঞে ।” বলিয়া শয়ন করিতে গেলেন। রঘুপতি সমস্ত রাত বেড়াইতে লাগিলেন । প্ৰভাতে জয়সিংহ গুরুকে প্ৰণাম করিয়া দাড়াইলেন । রঘুপতি কহিলেন, “জয়সিংহ, মায়ের বলি বন্ধ হইয়াছে ।” জয়সিংহ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সেকি কথা প্ৰভু !”