পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ֆ Հ রবীন্দ্র-রচনাবলী রঘুপতি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “সত্য নহিলে কি মিথ্যা কহিতেছি ? তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করা ?” জয়সিংহ রঘুপতির পদধূলি লইয়া কহিলেন, “গুরুদেবের প্রতি আমার বিশ্বাস শিথিল না হয় যেন । কিন্তু নক্ষত্ররায়েরও তো রাজকুলে জন্ম ।” রঘুপতি কহিলেন, “দেবতাদের স্বপ্ন ইঙ্গিতামাত্র ; সকল কথা শুনা যায় না, অনেকটা বুঝিয়া লইতে হয় । স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, গোবিন্দমাণিক্যের প্রতি দেবীর অসন্তোষ হইয়াছে, অসন্তোষের সম্পূর্ণ কারণও জন্মিয়াছে। অতএব দেবী যখন রাজরক্ত চাহিয়াছেন তখন বুঝিতে হইবে, তাহা গোবিন্দমাণিক্যেরই রক্ত ।” জয়সিংহ কহিলেন, “তা যদি সত্য হয়, তবে আমিই রাজরক্ত আনিব— নক্ষত্ররায়কে পাপে লিপ্ত করিব না ।” রঘুপতি কহিলেন, “দেবীর আদেশ পালন করিতে কোনো পাপ নাই ।” জয়সিংহ । পুণ্য আছে তো প্ৰভু । সে পুণ্য আমিই উপার্জন করিব । রঘুপতি কহিলেন, “তবে সত্য করিয়া বলি বৎস ! আমি তোমাকে শিশুকাল হইতে পুত্রের অধিক যত্নে প্ৰাণের অধিক ভালোবাসিয়া পালন করিয়া আসিয়াছি, আমি তোমাকে হারাইতে পারিব না । নক্ষত্ররায় যদি গোবিন্দমাণিক্যকে বধ করিয়া রাজা হয়, তবে কেহ তাহাতে একটি কথা কহিবে না, কিন্তু তুমি যদি রাজার গায়ে হাত তোল তো তোমাকে আর আমি ফিরিয়া পাইব না।” জয়সিংহ কহিলেন, “আমার স্নেহে— পিতা, আমি আপদার্থ— আমার স্নেহে তুমি একটি পিপীলিকারও হানি করিতে পরিবে না । আমার প্রতি স্নেহে তুমি যদি পাপে লিপ্ত হও, তবে তোমার সে স্নেহ আমি বেশিদিন ভোগ করিতে পারিব না, সে স্নেহের পরিণাম কখনোই ভালো হইবে না ।” রঘুপতি তাড়াতাড়ি কহিলেন, “আচ্ছা আচ্ছা, সে কথা পরে হইবে । কাল নক্ষত্ররায় আসিলে যা হয় একটা ব্যবস্থা হইবে ।” ভ্ৰাতৃহত্যা ঘটিতে দিব না ।” সপ্তম পরিচ্ছেদ জয়সিংহের সমস্ত রাত্রি নিদ্রা হইল না । গুরুর সহিত যে কথা লইয়া আলোচনা হইয়াছিল, দেখিতে দেখিতে তাহার শাখাপ্ৰশাখা বাহির হইতে লাগিল । অধিকাংশ সময়েই আরম্ভ আমাদের আয়ত্ত, শেষ আমাদের আয়ত্ত নহে । চিন্তা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে । জয়সিংহের মনে অনিবার্য বেগে এমন-সকল কথা উঠিতে লাগিল যাহা তাহার আশৈশব বিশ্বাসের মূলে অবিশ্রাম আঘাত করিতে লাগিল। জয়সিংহ পীড়িত ক্লিষ্ট হইতে লাগিলেন । কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো ভাবনা কিছুতেই ক্ষান্ত হইতে চায় না । যে দেবীকে জয়সিংহ এতদিন মা বলিয়া জানিতেন, গুরুদেব আজ কেন তাহার মাতৃত্ব অপহরণ করিলেন, কেন তাহাকে হৃদয়হীন শক্তি বলিয়া ব্যাখ্যা করিলেন ! শক্তির সন্তোষই কী, আর অসন্তোষই বা কী ! শক্তির চক্ষুই বা কোথায়, কর্ণই বা কোথায় ! শক্তি তো মহারথের ন্যায় তাহার সহস্ৰ চক্রের তলে জগৎ কৰ্ষিত করিয়া ঘর্ঘর শব্দে চলিয়া যাইতেছে, তাহাকে অবলম্বন করিয়া কে চলিল, তাহার তলে পড়িয়া কে চূর্ণ হইল, তাহার উপরে উঠিয়া কে উৎসব করিতেছে, তাহার নিমে পড়িয়া কে আর্তনাদ করিতেছে, সে তাহার কী জানিবে !! তাহার সারথি কি কেহ নাই ? পৃথিবীর নিরীহ অসহায় ভীরু জীবদিগের রক্ত বাহির করিয়া কালরূপিণী নিষ্ঠুর শক্তির তৃষা নির্বাণ করিতে হইবে এই কি আমার ব্ৰত ! কেন ? সে তো আপনার কােজ আপনিই করিতেছে- তাহার দুর্ভিক্ষ আছে, বন্যা আছে, ভূমিকম্প আছে, জরা মারী অগ্নিদাহ আছে, নির্দয়মানবহৃদয়স্থিত হিংসা আছে- ক্ষুদ্র আমাকে তাহার আবশ্যক কী !