পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি A SV) তাহার পরদিন যে প্রভাত হইল তাহা অতি মনােহর প্রভাত। বৃষ্টি শেষ হইয়াছে। পূর্ব দিকে মেঘ নাই। সূর্যকিরণ যেন বর্ষার জলে ধীেত ও স্নিগ্ধ। বৃষ্টিবিন্দু ও সূর্যকিরণে দশ দিক ঝলমল করিতেছে। শুভ্র আনন্দপ্রভা আকাশে প্রান্তরে অরণ্যে নদীস্রোতে বিকশিত শ্বেতশতদলের ন্যায় পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। নীল আকাশে চিল ভাসিয়া যাইতেছে- ইন্দ্ৰধনুর তোরণের নীচে দিয়া বকের শ্রেণী উড়িয়া চলিয়াছে। কাঠবিড়ালিরা গাছে গাছে ছুটািছুটি করিতেছে। দুই-একটি অতি ভীরু খরগোশ সচকিতে ঝোপের ভিতর হইতে বাহির হইয়া আবার আড়াল খুঁজিতেছে। ছাগশিশুরা অতি দুৰ্গম পাহাড়ে উঠিয়া ঘাস ছিড়িয়া খাইতেছে। গোরুগুলি আজ মনের আনন্দে মােঠ-ময় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। রাখাল গান ধরিয়াছে। কলসকক্ষ মায়ের আঁচল ধরিয়া আজ ছেলেমেয়েরা বাহির হইয়াছে। বৃদ্ধ পূজার জন্য ফুল তুলিতেছে। স্নানের জন্য নদীতে আজ অনেক লোক সমবেত হইয়াছে, কলকল স্বরে তাহারা গল্প করিতেছে- নদীর কলধ্বনিরও বিরাম নাই। আষাঢ়ের প্রভাতে এই জীবময়ী আনন্দময়ী ধরণীর দিকে চাহিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জয়সিংহ মন্দিরে প্রবেশ করিলেন । জয়সিংহ প্ৰতিমার দিকে চাহিয়া জোড়হস্তে কহিলেন, “কেন মা, আজ এমন অপ্ৰসন্ন কেন ? একদিন তোমার জীবের রক্ত তুমি দেখিতে পাও নাই বলিয়া এত ভ্ৰকুটি । আমাদের হৃদয়ের মধ্যে চাহিয়া দেখো, ভক্তির কি কিছু অভাব দেখিতেছি ? ভক্তের হৃদয় পাইলেই কি তোমার তৃপ্তি হয় না, নিরপরাধের শোণিত চাই ? আচ্ছা মা, সত্য করিয়া বল দেখি, পুণ্যের-শরীর গোবিন্দমাণিক্যকে পৃথিবী হইতে অপসৃত করিয়া এখানে দানবের রাজত্ব স্থাপন করাই কি তোর অভিপ্ৰায়। রাজরক্ত কি নিতান্তই চাই ? তোর মুখের উত্তর না শুনিলে আমি কখনোই রাজহত্যা ঘটিতে দিব না, আমি ব্যাঘাত করিব । বল, হঁহা কি না ।” সহসা বিজন মন্দিরে শব্দ উঠিল, “ই ।” জয়সিংহ চমকিয়া পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলেন, কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না, মনে হইল যেন ছায়ার মতো কী একটা কঁপিয়া গেল । স্বর শুনিয়া প্ৰথমেই র্তাহার মনে হইয়াছিল, যেন তার গুরুর কণ্ঠস্বর । পরে মনে করিলেন, মা তাহাকে তাহার গুরুর কণ্ঠস্বরেই আদেশ করিলেন ইহাই সম্ভব । তাহার গাত্র রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল । তিনি প্রতিমাকে ভূমিষ্ঠ প্ৰণাম করিয়া সশস্ত্ৰে বাহির হইয়া পড়িলেন । অষ্টম পরিচ্ছেদ গােমতী নদীর দক্ষিণ দিকের এক স্থানের পাড় অতিশয় উচ্চ । বর্ষার ধারা ও ছােটাে ছােটাে স্রোত এই উন্নত ভূমিকে নানা গুহাগহবরে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। ইহার কিছু দূরে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে বড়ো বড়ো শাল ও গাম্ভারি গাছে এই শতধাবিদীর্ণ ভূমিখণ্ডকে ঘিরিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু মাঝখানের এই জমিটুকুর মধ্যে বড়ো গাছ একটিও নাই। কেবল স্থানে স্থানে ঢিপির উপর ছােটাে ছােটাে শাল গাছ বাড়িতে পারিতেছে না, বাকিয়া কালো হইয়া পড়িয়াছে। বিস্তর পাথর ছড়ানো । এক-হাত দুই-হাত প্রশস্ত ছােটাে ছােটাে জলস্রোত কত শত আঁকাবঁকা পথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া, মিলিয়া, বিভক্ত হইয়া, নদীতে গিয়া পড়িতেছে। এই স্থান অতি নির্জন— এখানকার আকাশ গাছের দ্বারা অবরুদ্ধ নহে। এখােন হইতে গোমতী নদী এবং তাহার পরপারের বিচিত্ৰবৰ্ণ শস্যক্ষেত্ৰসকল অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। প্রতিদিন প্ৰাতে রাজা গো এইখানে বেড়াইতে আসিতেন, সঙ্গে একটি সঙ্গী বা একটি অনুচরও আসিত না । জেলেরা কখনো কখনো গােমতীতে মাছ ধরিতে আসিয়া দূর হইতে দেখিতে পাইত, তাহাদের সৌম্যমূর্তি রাজা যোগীর ন্যায় স্থিরভাবে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বসিয়া আছেন, তাহার মুখে প্রভাতের জ্যোতি কি তাহার আত্মার জ্যোতি বুঝা যাইত না। আজকাল বর্ষার দিনে প্রতিদিন এখানে আসিতে পারিতেন না, কিন্তু বর্ষা-উপশমে যেদিন আসিতেন সেদিন ছােটাে তাতাকে সঙ্গে করিয়া আনিতেন । তাতাকে আর তােতা বলিতে ইচ্ছা করে না। একমাত্র যাহার মুখে তাতা সম্বোধন মানাইত সে তো