পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ Տ Տ উঠিয়া দাড়াইয়া মহারাজ গভীরস্বরে বলিলেন, “নক্ষত্র, আজ অপরাহুে গোমতীতীরের নির্জন অরণ্যে আমরা দুইজনে বেড়াইতে যাইব ।” রাজার এই গভীর আদেশবাণীর বিরুদ্ধে নক্ষত্রের মুখে কথা সরিল না, কিন্তু সংশয়ে ও আশঙ্কায় তাহার মন আকুল হইয়া উঠিল । তাহার মনে হইতে লাগিল, মহারাজ এতক্ষণ নীরবে দুই চক্ষু তাঁহারই মনের দিকে নিবিষ্ট করিয়া বসিয়াছিলেন- সেখানে অন্ধকার গর্তের মধ্যে যে ভাবনাগুলো কীটের মতো কিলবিল করিতেছিল, সেগুলো যেন সহসা আলো দেখিয়া অস্থির হইয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছে ! ভয়ে ভয়ে নক্ষত্ররায় রাজার মুখের দিকে একবার চাহিলেন— দেখিলেন তাহার মুখে কেবল সুগভীর বিষন্ন শান্তির ভাব, সেখানে রোয্যের রেখামাত্র নাই। মানবহৃদয়ের কঠিন নিষ্ঠুরতা দেখিয়া কেবল সুগভীর শোক তাহার হৃদয়ে বিরাজ করিতেছিল। বেলা পডিয়া আসিল । তখনো মেঘ করিয়া আছে। নক্ষত্ররায়কে সঙ্গে লইয়া মহারাজ পদব্ৰজে অরণ্যের দিকে চলিলেন । এখনো সন্ধ্যা হইতে বিলম্ব আছে, কিন্তু মেঘের অন্ধকারে সন্ধ্যা বলিয়া ভ্ৰম হইতেছে— কাকেরা অরণ্যের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া অবিশ্রাম চীৎকার করিতেছে, কিন্তু দুই-একটা চিল এখনো আকাশে সাতার দিতেছে । দুই ভাই যখন নির্জন বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন, তখন নক্ষত্ররায়ের গা ছমছম করিতে লাগিল ৷ বড়ো বড়ো প্রাচীন গাছ জটলা করিয়া দাড়াইয়া আছে— তাহারা একটি কথা কহে না, কিন্তু স্থির হইয়া যেন কীটের পদশব্দটুকু পর্যন্তও শোনে ; তাহারা কেবল নিজের ছায়ার দিকে, তলস্থিত অন্ধকারের দিকে অনিমেষ নেত্ৰে চাহিয়া থাকে । অরণ্যের সেই জটিল রহস্যের ভিতরে পদক্ষেপ করিতে নক্ষত্ররায়ের পা যেন আর উঠে না- চারি দিকে সুগভীর নিস্তব্ধতার ভুকুটি দেখিয়া হৃৎকম্প উপস্থিত হইতে লাগিল ; নক্ষত্ররায়ের অত্যন্ত সন্দেহ ও ভয় জন্মিল ; ভীষণ অদৃষ্টের মতো নীরব রাজা এই সন্ধ্যাকালে এই পৃথিবীর অন্তরাল দিয়া তাহাকে কোথায় লইয়া যাইতেছেন কিছুই ঠাহর পাইলেন না । নিশ্চয় মনে করিলেন, রাজার কাছে ধরা পড়িয়াছেন, এবং গুরুতর শাস্তি দিবার জন্যই রাজা তাহাকে এই অরণ্যের মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছেন । নক্ষত্ররায় উর্ধবশ্বাসে পালাইতে পারিলে বাচেন, কিন্তু মনে হইল কে যেন তাহার হাত-পা বাধিয়া টানিয়া লইয়া যাইতেছে। কিছুতেই আর পরিত্রাণ নাই । অরণ্যের মধ্যস্থলে কতকটা ফাকা । একটি স্বাভাবিক জলাশয়ের মতো আছে, বর্ষাকালে তাহা জলে পরিপূর্ণ। সেই জলাশয়ের ধারে সহসা ফিরিয়া দাড়াইয়া রাজা বলিলেন, “দাড়াও !” নক্ষত্ররায় চমকিয়া দাড়াইলেন । মনে হইল রাজার আদেশ শুনিয়া সেই মুহুর্তে কালের স্রোত যেন বন্ধ হইল— সেই মুহুর্তেই যেন অরণ্যের বৃক্ষগুলি যে যেখানে ছিল কুঁকিয়া দাড়াইল— নীচে হইতে ধারণী এবং উপর হইতে আকাশ যেন নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল । কাকের কোলাহল থামিয়া গেছে, বনের মধ্যে একটি শব্দ নাই । কেবল সেই “দাড়াও’ শব্দ অনেকক্ষণ ধরিয়া যেন গম গম করিতে লাগিল— সেই “দাড়াও’ শব্দ যেন তড়িৎপ্রবাহের মতো বৃক্ষ হইতে বৃক্ষান্তরে, শাখা হইতে প্রশাখায় প্রবাহিত হইতে লাগিল ; অরণ্যের প্রত্যেক পাতাটা যেন সেই শব্দের কম্পনে রী রা করিতে লাগিল । নক্ষত্ররায়ও যেন গাছের মতোই স্তব্ধ হইয়া দাড়াইলেন । রাজা তখন নক্ষত্ররায়ের মুখের দিকে মৰ্মভেদী স্থির বিষন্ন দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া প্রশাস্তু গন্তীর স্বরে ধীরে ধীরে কহিলেন, “নক্ষত্র, তুমি আমাকে মারিতে চাও ?” নক্ষত্র বাজাহতের মতো দাড়াইয়া রহিলেন, উত্তর দিবার চেষ্টাও করিতে পারিলেন না । রাজা কহিলেন, “কেন মারিবে ভাই ? রাজ্যের লোভে ? তুমি কি মনে কর রাজ্য কেবল সোনার সিংহাসন, হীরার মুকুট ও রাজছত্ৰ ? এই মুকুট, এই রাজছত্ৰ, এই রাজদণ্ডের ভার কত তাহা জান ? শত-সহস্ৰ লোকের চিন্তা এই হীরার মুকুট দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছি। রাজ্য পাইতে চাও তো সহস্ৰ লোকের দুঃখকে আপনার দুঃখ বলিয়া গ্রহণ করো, সহস্ৰ লোকের বিপদকে আপনার বিপদ বলিয়া বরণ করো, সহস্ৰ লোকের দারিদ্র্যকে আপনার দারিদ্র্য বলিয়া স্কন্ধে বহন করো— এ যে করে সে-ই রাজা, সে পর্ণকুটিরেই থাক। আর প্রাসাদেই থাক। যে ব্যক্তি সকল লোককে আপনার বলিয়া মনে