পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি S লইয়া আছেন। দীপের ক্ষীণ আলোকে কেবল তাঁহাদের দুইজনের মুখের অন্ধকার দেখা যাইতেছে। নক্ষত্ররায় রঘুপতিকে দেখিয়া মুখ তুলিতে পারিলেন না ; রাজার ছায়ায় দাড়াইয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিলেন- রাজা তঁহাকে পাশে টানিয়া লইয়া দৃঢ়রপে র্তাহার হাত ধরিয়া দাড়াইলেন ও স্থির নেত্ৰে রঘুপতির মুখের দিকে একবার চাহিলেন। রঘুপতি তীব্ৰদূষ্টিতে নক্ষত্ররায়ের প্রতি কটাক্ষপাত করিলেন। অবশেষে রাজা রঘুপতিকে প্ৰণাম করিলেন, নক্ষত্ররায়ও তাহার অনুসরণ করিলেন। রঘুপতি প্ৰণাম গ্রহণ করিয়া গভীর স্বরে কহিলেন, “জয়ােস্তু— রাজ্যের কুশল ?” রাজা একটুখানি থামিয়া বলিলেন, “ঠাকুর, আশীর্বাদ করুন, রাজ্যের অকুশল না ঘটুক । এ রাজ্যে মায়ের সকল সন্তান যেন সদ্ভাবে প্রেমে মিলিয়া থাকে, এ রাজ্যে ভাইয়ের কাছ হইতে ভাইকে কেহ যেন কাড়িয়া না লয়, যেখানে প্ৰেম আছে সেখানে কেহ যেন হিংসার প্রতিষ্ঠা না করে । রাজ্যের অমঙ্গল আশঙ্কা করিয়াই আসিয়াছি। পাপ-সংকল্পের সংঘর্ষণে দাবানল জ্বলিয়া উঠিতে পারে- নির্বাণ করুন, শান্তির বারি বর্ষণ করুন, পৃথিবী শীতল করুন।” রঘুপতি কহিলেন, “দেবতার রোষানল জ্বলিয়া উঠিলে কে তাহা নির্বাণ করিবে ? এক অপরাধীর জন্য সহস্র নিরপরাধ সে অনলে দগ্ধ হয় ।” রাজা বলিলেন, “সেই তো ভয়, সেইজন্যই তো কঁাপিতেছি। সে কথা কেহ বুঝিয়াও বোঝে না। কেন ! আপনি কি জানেন না, এ রাজ্যে দেবতার নাম করিয়া দেবতার নিয়ম লঙঘন করা হইতেছে ? সেইজন্যই অমঙ্গল-আশঙ্কায় আজ সন্ধ্যাবেলায় এখানে আসিয়াছি— এখানে পাপের বৃক্ষ রোপণ করিয়া আমার এই ধনধান্যময় সুখের রাজ্যে দেবতার বাজ আহবান করিয়া আনিবেন না। আপনাকে এই কথা বলিয়া গেলাম, এই কথা বলিবার জন্যই আমি আজ আসিয়াছিলাম।” বলিয়া মহারাজ রঘুপতির মুখের উপর তাহার মর্মভেদী দৃষ্টি স্থাপন করিলেন । রাজার সুগভীর দৃঢ়স্বর রুদ্ধ ঝটিকার মতো কুটিরের মধ্যে কঁাপিতে লাগিল। রঘুপতি একটি উত্তর দিলেন না, পইতা লইয়া নাড়িতে লাগিলেন । রাজা প্ৰণাম করিয়া নক্ষত্ররায়ের হাত ধরিয়া বাহির হইয়া আসিলেন, সঙ্গে সুরমািসাহও বাহির হইলেন । ঘরের মধ্যে কেবল একটি দীপ, রঘুপতি এবং রঘুপতির বৃহৎ ছায়া তখন আকাশের আলো নিবিয়া গেছে । মেঘের মধ্যে তারা নিমগ্ন । আকাশের কানায় কানায় । অন্ধকার । পুবে বাতাসে সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কোথা হইতে কদম ফুলের গন্ধ পাওয়া যাইতেছে এবং অরণ্যে মর্মরশব্দ শুনা যাইতেছে। ভাবনায় নিমগ্ন হইয়া পরিচিত পথ দিয়া রাজা চলিতেছেন, সহসা পশ্চাৎ হইতে শুনিলেন কে ডাকিল- “মহারাজ !” রাজা ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি ?” পরিচিত স্বর কহিল, “আমি আপনার অধম সেবক, আমি জয়সিংহ। মহারাজ, আপনি আমার গুরু, আমার প্রভু। আপনি ছাড়া আমার আর কেহ নাই। যেমন আপনি আপনার কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাত ধরিয়া অন্ধকারের মধ্যে দিয়া লইয়া যাইতেছেন, তেমনি আমারও হাত ধরুন, আমাকেও সঙ্গে লইয়া যান ; আমি গুরুতর অন্ধকারের মধ্যে পড়িয়াছি। আমার কিসে ভালো হইবে, কিসে মন্দ হইবে, কিছুই জানি না । আমি একবার বামে যাইতেছি, একবার দক্ষিণে যাইতেছি, আমার কর্ণধার কেহ নাই ।” আদ্র স্বর কঁাপিতে কঁাপিতে রাজার কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল । স্তব্ধ স্থির অন্ধকার বায়ুচঞ্চল সমুদ্রের মতো কঁাপিতে লাগিল । রাজা জয়সিংহের হাত ধরিয়া বলিলেন, “চলো, আমার সঙ্গে প্রাসাদে চলো ।” di 8 Ve