পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१S२७ রবীন্দ্র-রচনাবলী লাগিলেন, “হিরণ্যকশিপু নামে এক রাজা ছিল।” - রাজা শুনিয়া ধ্রুব বলিয়া উঠিল, “আমি আজা ।” মস্ত ঢিলে মুকুটের জোরে হিরণ্যকশিপুর রাজপদ সে একেবারে অগ্রাহ্য করিল। চাটুভাষী সভাসদের ন্যায় গোবিন্দমাণিক্য সেই কিরীটি শিশুকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য বলিলেন, “তুমিও আজা, সেও আজ ।” ধ্রুব তাহাতেও সুস্পষ্ট অসম্মতি প্রকাশ করিয়া বলিল, “না, আমি আজ ।” অবশেষে মহারাজ যখন বলিলেন, “হিরণ্যকশিপু আজ নয়, সে আক্কাস", তখন ধ্রুব তাহাতে আপত্তি করিবার কিছুই দেখিল না । এমন সময় নক্ষত্ররায় গৃহে প্ৰবেশ করিলেন— কহিলেন, “শুনিলাম রাজকার্যোপলক্ষে মহারাজ আমাকে ডাকিয়াছেন । আদেশের জন্য প্ৰতীক্ষা করিতেছি ।” রাজা কহিলেন, “আর-একটু অপেক্ষা করো, গল্পটা শেষ করিয়া লই ।” বলিয়া গল্পটা সমস্ত শেষ করিলেন । “আক্কাস দুষ্টু”— গল্প শুনিয়া সংক্ষেপে ধ্রুব এইরূপ মত প্ৰকাশ করিল। ধ্ৰুবের মাথায় মুকুট দেখিয়া নক্ষত্ররায়ের ভালো লাগে নাই। ধ্রুব যখন দেখিল নক্ষত্ররায়ের দৃষ্টি তাহার দিকে স্থাপিত রহিয়াছে, তখন সে নক্ষত্ররায়কে গভীরভাবে জানাইয়া দিল, “আমি আজ ।” নক্ষত্ৰ বলিলেন, “ছি, ও কথা বলিতে নাই।” বলিয়া ধুবের মাথা হইতে মুকুট তুলিয়া লইয়া রাজার হাতে দিতে উদ্যত হইলেন । ধ্রুব মুকুটহরণের সম্ভাবনা দেখিয়া সত্যকার রাজাদের মতো চীৎকার করিয়া উঠিল । গোবিন্দমাণিক্য তাহাকে এই আসন্ন বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন, নক্ষত্ৰকে নিবারণ করিলেন । অবশেষে গোবিন্দমাণিক্য নক্ষত্ররায়কে কহিলেন, “শুনিয়াছি। রঘুপতি ঠাকুর অসৎ উপায়ে প্রজাদের অসন্তোষ উদ্রেক করিয়া দিতেছেন । তুমি স্বয়ং নগরের মধ্যে গিয়া এ বিষয়ে তদারক করিয়া আসিবে এবং সত্য মিথ্যা অবধারণ করিয়া আমাকে জানাইবে ।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “ যে আজ্ঞে ।” বলিয়া চলিয়া গেলেন, কিন্তু ধ্রুবের মাথায় মুকুট তাহার কিছুতেই ভালো লাগিল না । প্রহরী আসিয়া কহিল, “পুরোহিত ঠাকুরের সেবক জয়সিংহ সাক্ষাৎ-প্রার্থনায় দ্বারে দাড়াইয়া ।” জয়সিংহ মহারাজকে প্ৰণাম করিয়া করজোড়ে কহিলেন, “মহারাজ, আমি বহুদূরদেশে চলিয়া যাইতেছি । আপনি আমার রাজা, আমার গুরু, আপনার আশীর্বাদ লইতে আসিয়াছি।” রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইবে জয়সিংহ ?” জয়সিংহ কহিলেন, “জানি না মহারাজ, কোথায় তাহা কেহ বলিতে পারে না ।” রাজাকে কথা কহিতে উদ্যত দেখিয়া জয়সিংহ কহিলেন, “নিষেধ করিবেন না মহারাজ ! আপনি নিষেধ করিলে আমার যাত্রা শুভ হইবে না ; আশীর্বাদ করুন, এখানে আমার যে-সকল সংশয় ছিল, সেখানে যেন সে-সকল সংশয় দূর হইয়া যায়। এখানকার মেঘ সেখানে যেন কাটিয়া যায়। যেন আপনার মতো রাজার রাজত্বে যাই, যেন শান্তি পাই ।” রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কবে যাইবে ?” জয়সিংহ কহিলেন, “আজি সন্ধ্যাকালে । অধিক সময় নাই মহারাজ, আজ আমি তবে বিদায় হই ।” বলিয়া রাজাকে প্ৰণাম করিয়া রাজার পদধূলি লইলেন, রাজার চরণে দুই ফোটা অশ্রু পড়িল । জয়সিংহ উঠিয়া যখন যাইতে উদ্যত হইলেন তখন ধ্রুব ধীরে ধীরে গিয়া তাহার কাপড় টানিয়া কহিল, “তুমি যেয়ে না।” জয়সিংহ হাসিয়া ফিরিয়া দাড়াইলেন, ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইয়া তাহাকে চুম্বন করিয়া কহিলেন, “কার কাছে থাকিব বৎস ? আমার কে আছে ?” ধ্রুব কহিল, “আমি আজ ।”