পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ԳՀԳ জয়সিংহ কহিলেন, “তোমরা রাজার রাজা, তোমরাই সকলকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছ ।” ধ্রুবকে কোল হইতে নামাইয়া জয়সিংহ গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন । মহারাজ গভীরমুখে অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতে লাগিলেন । পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ চতুর্দশী তিথি । মেঘও করিয়াছে, চাদ ও উঠিয়াছে । আকাশের কোথাও আলো কোথাও অন্ধকার । কখনো চাদ বাহির হইতেছে, কখনো চাদ লুকাইতেছে । গোমতীতীরের অরণ্যগুলি চাদের দিকে চাহিয়া তাহাদের গভীর অন্ধকাররাশির মর্মভেদ করিয়া মাঝে মাঝে নিশ্বাস ফেলিতেছে । আজ রাত্রে পথে লোক বাহির হওয়া নিষেধ । রাত্রে পথে লোক কেই-বা বাহির হয় । কিন্তু নিষেধ আছে বলিয়া পথের বিজনতা আজ আরো গভীর বোধ হইতেছে । নগরবাসীরা সকলেই আপনার ঘরের দীপ নিবাইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়াছে। পথে একটি প্রহরী নাই । চোরও আজ পথে বাহির হয় না । যাহারা শ্মশানে শবদাহ করিতে যাইবে তাহারা মৃতদেহ ঘরে লইয়া প্ৰভাতের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া আছে। ঘরে যাহাদের সন্তান মুম্ষু তাহারা বৈদ্য ডাকিতে বাহির হয় না । যে ভিক্ষুক পথপ্রান্তে বৃক্ষতলে শয়ন করিত সে আজ গৃহস্থের গোশালায় আশ্রয় লইয়াছে । সে রাত্ৰে শৃগাল-কুকুর নগরের পথে পথে বিচরণ করিতেছে, দুই-একটা চিতাবাঘ গৃহস্থের দ্বারের কাছে আসিয়া উকি মারিতেছে । মানুষের মধ্যে কেবল একজন মাত্র আজ গৃহের বাহিরে আছে--- আর মানুষ নাই । সে একখানা ছুরি লইয়া নদীতীরে পাথরের উপর শান দিতেছে, এবং অন্যমনস্ক হইয়া কী ভাবিতেছে। ছুরির ধার যথেষ্ট ছিল, কিন্তু সে বোধ করি ছুরির সঙ্গে সঙ্গে ভাবনাতেও শান দিতেছিল, তাই তার শান দেওয়া আর শেষ হইতেছে না । প্রস্তরের ঘর্ষণে তীক্ষ ছুরি হিসহিস শব্দ করিয়া হিংসার লালসায় তপ্ত হইয়া উঠিতেছে । অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকার নদী বহিয়া যাইতেছিল । জগতের উপর দিয়া অন্ধকার রজনীর প্রহর বহিয়া যাইতেছিল । আকাশের উপর দিয়া অন্ধকার ঘনামেঘের স্রোত ভাসিয়া যাইতেছিল । অবশেষে যখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইল তখন জয়সিংহের চেতনা হইল | তপ্ত ছুরি খাপের মধ্যে পুরিয়া উঠিয়া দাড়াইলেন । পূজার সময় নিকটবর্তী হইয়াছে ! তাহার শপথের কথা মনে পড়িয়াছে । আর এক দণ্ডও বিলম্ব করিলে চলিবে না । মন্দির আজ সহস্র দীপে আলোকিত | ত্ৰয়োদশ দেবতার মাঝখানে কালী দাড়াইয়া নররক্তের জন্য জিহবা মেলিয়াছেন । মন্দিরের সেবকদিগকে বিদায় করিয়া দিয়া চতুৰ্দশ দেবপ্রতিমা সম্মুখে করিয়া রঘুপতি একাকী বসিয়া আছেন । তাহার সম্মুখে এক দীর্ঘ খাড়া । উলঙ্গ উজ্জ্বল খড়গ দীপালোকে বিভাসিত হইয়া স্থির বজের ন্যায় দেবীর আদেশের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে । অর্ধরাত্রে পূজা । সময় নিকটবর্তী। রঘুপতি অত্যন্ত অস্থিরচিত্তে জয়সিংহের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছেন । সহসা ঝড়ের মতো বাতাস উঠিয়া মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইল। বাতাসে মন্দিরের সহস্ৰ দীপশিখা কঁাপিতে লাগিল, উলঙ্গ খড়েগর উপর বিদ্যুৎ খেলিতে লাগিল । চতুর্দশ দেবতা এবং রঘুপতির ছায়া যেন জীবন পাইয়া দীপশিখার নৃত্যের তালে তালে মন্দিরের ভিত্তিময় নাচিতে লাগিল । একটা নরকপাল ঝড়ের বাতাসে ঘরময় গড়াইতে লাগিল। মন্দিরের মধ্যে দুইটা চামচিকা আসিয়া শুষ্ক পত্রের মতো ক্রমাগত উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। দেয়ালে তাঁহাদের ছায়া উড়িতে লাগিল । দ্বিপ্রহর হইল। প্রথমে নিকটে, পরে দূর-দূরান্তরে শৃগাল ডাকিয়া উঠিল । ঝড়ের বাতাসও তাহাদের সঙ্গে মিলিয়া হু হু করিয়া কঁদিতে লাগিল। পূজার সময় হইয়াছে। রঘুপতি অমঙ্গল-আশঙ্কায় অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন । এমন সময় জীবন্ত ঝড়বৃষ্টিবিদ্যুতের মতো জয়সিংহ নিশীথের অন্ধকারের মধ্য হইতে সহসা মন্দিরের আলোকের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । দীর্ঘ চাদরে দেহ আচ্ছাদিত, সর্বাঙ্গ বাহিয়া বৃষ্টিধারা