পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

qA Sbr রবীন্দ্র-রচনাবলী পড়িতেছে, নিশ্বাস বেগে বহিতেছে, চক্ষুতারকায় অগ্নিকণা জুলিতেছে। রঘুপতি তাহাকে ধরিয়া কানের কাছে মুখ দিয়া কহিলেন, “রাজরক্ত আনিয়াছ ?” জয়সিংহ তাহার হাত ছাড়াইয়া উচ্চস্বরে কহিলেন, “আনিয়াছি। রাজরক্ত আনিয়াছি। আপনি সরিয়া দাঁড়ান, আমি দেবীকে নিবেদন করি।” শব্দে মন্দির কঁপিয়া উঠিল । কালীর প্রতিমার সম্মুখে দাড়াইয়া বলিতে লাগিলেন, “সত্যই কি তবে তুই সন্তানের রক্ত চাস মা ! রাজরক্ত নাহিলে তোর তৃষা মিটিবে না ? জন্মাবধি আমি তোকেই মা বলিয়া আসিয়াছি, আমি তোরই সেবা করিয়াছি, আমি আর-কাহারও দিকে চাই নাই, আমার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না । আমি রাজপুত, আমি ক্ষত্ৰিয়, আমার প্রপিতামহ রাজা ছিলেন, আমার মাতামহ বংশীয়েরা আজও রাজত্ব করিতেছেন । এই নে তবে তোর সন্তানের রক্ত, তোর রাজরক্ত এই নে ৷” গাত্র হইতে চাদর পড়িয়া গেল । কটিবন্ধ হইতে ছুরি বাহির করিলেন- বিদ্যুৎ নাচিয়া উঠিল— চকিতের মধ্যে সেই ছুরি আমূল তাহার হৃদয়ে নিহিত করিলেন, মরণের তীক্ষ জিহবা তাহার বক্ষে বিদ্ধ হইল। প্রতিমার পদতলে পড়িয়া গেলেন ; পাষাণপ্ৰতিমা বিচলিত হইল না । রঘুপতি চীৎকার করিয়া উঠিলেন— জয়সিংহকে তুলিবার চেষ্টা করিলেন, তুলিতে পারিলেন না। লাগিল । ক্রমে দীপগুলি একে একে নিবিয়া গেল । অন্ধকারের মধ্যে সমস্ত রাত্রি একটি প্রাণীর নিশ্বাসের শব্দ শুনা গেল ; রাত্রি তৃতীয় প্রহরের সময় ঝড় থামিয়া চারি দিক নিস্তব্ধ হইয়া গেল। রাত্রি চতুর্থ প্রহরের সময় মেঘের ছিদ্ৰ দিয়া চন্দ্রালোক মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিল । চন্দ্রালোক জয়সিংহের পাণ্ডুবৰ্ণ মুখের উপর পড়িল, চতুৰ্দশ দেবতা শিয়রে দাড়াইয়া তাঁহাই দেখিতে লাগিল। প্ৰভাতে বন হইতে যখন পাখি ডাকিয়া উঠিল, তখন রঘুপতি মৃতদেহ ছাড়িয়া উঠিয়া গেলেন । ষোড়শ পরিচ্ছেদ রাজার আদেশমত প্রজাদের অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য নক্ষত্ররায় স্বয়ং প্ৰাতঃকালে বাহির হইয়াছেন । তাহার ভাবনা হইতে লাগিল, মন্দিরে কী করিয়া যাই । রঘুপতির সম্মুখে পড়িলে তিনি কেমন অস্থির হইয়া পড়েন, আত্মসম্বরণ করিতে পারেন না । রঘুপতির সম্মুখে পড়িতে তাহার সম্পূর্ণ অনিচ্ছা । এইজন্য তিনি স্থির করিয়াছেন, রঘুপতির দৃষ্টি এড়াইয়া গোপনে জয়সিংহের কক্ষে গিয়া তাহার নিকট হইতে সবিশেষ বিবরণ অবগত হইতে পরিবেন । । পারিলে বাচি । দেখিলেন জয়সিংহের পুঁথি, তাহার বসন, র্তাহার গৃহসজ্জা চারি দিকে ছড়ানো রহিয়াছে, মাঝখানে রঘুপতি বসিয়া। জয়সিংহ নাই। রঘুপতির লোহিত চক্ষু অঙ্গারের ন্যায় জ্বলিতেছে, তাহার কেশপাশ বিশৃঙ্খল । তিনি নক্ষত্ররায়কে দেখিয়াই দৃঢ় মুষ্টিতে র্তাহার হাত ধরিলেন । বলপূর্বক তাহাকে মাটিতে বসাইলেন । নক্ষত্ররায়ের প্রাণ উড়িয়া গেল। রঘুপতি তাহার অঙ্গীরনয়নে নক্ষত্ররায়ের মর্মস্থান পর্যন্ত দগ্ধ করিয়া পাগলের মতো বলিলেন, “রক্ত কোথায় ?” নক্ষত্ররায়ের হৃৎপিণ্ডে রক্তের তরঙ্গ উঠিতে লাগিল, মুখ দিয়া কথা সরিল না । রঘুপতি উচ্চস্বরে বলিলেন, “তোমার প্রতিজ্ঞা কোথায় ? রক্ত কোথায় ?” নক্ষত্ররায় হাত নাড়িলেন, পা নাড়িলেন, বামে সরিয়া বসিলেন, কাপড়ের প্রান্ত ধরিয়া টানিতে লাগিলেন- তাহার ঘর্ম বহিতে লাগিল, তিনি শুল্কমুখে বলিলেন, “ঠাকুর-” রঘুপতি কহিলেন, “এবার মা যে স্বয়ং খড়গ তুলিয়াছেন, এবার চারিদিকে যে রক্তের স্রোত বহিতে থাকিবে- এবার তোমাদের বংশে এক ফোটা রক্ত যে বাকি থাকিবে না। তখন দেখিব নক্ষত্ররায়ের ভ্ৰাতৃস্নেহ !