পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A\OO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পইতা স্পর্শ করিয়া রঘুপতি বলিলেন, “যদি না আনিতে পাের তো ব্ৰাহ্মণের অভিশাপ লাগিবে। তা হইলে, যে মুখে তুমি প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করিয়া পালন না কর, ত্রিরাত্রি না পোহাইতে সেই মুখের মাংস শকুনি ছিড়িয়া ছিড়িয়া খাইবে।” শুনিয়া নক্ষত্ররায় চমকিয়া মুখে হাত বুলাইলেন— কোমল মাংসের উপরে শকুনির চঞ্চপাত -কল্পনা তাহার নিতান্ত দুঃসহ বোধ হইল। রঘুপতিকে প্ৰণাম করিয়া তিনি তাড়াতাড়ি বিদায় লইলেন। সে ঘর হইতে আলোক বাতাস ও জনকোলাহলের মধ্যে গিয়া নক্ষত্ররায় পুনর্জীবন লাভ করিলেন। সপ্তদশ পরিচ্ছেদ তাহার গলা জড়াইয়া তাহার কপোলে কপোল দিয়া মুখের কাছে মুখ রাখিল । চুপি চুপি বলিল, নক্ষত্ৰ কহিলেন, “ছি, ও কথা বোলো না, আমি তোমার কােকা না ।” ধ্রুব তাহাকে এতকাল বরাবর কাকা বলিয়া আসিতেছিল, আজ সহসা বারণ শুনিয়া সে ভরি আশ্চর্য হইয়া গেল। গভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল ; তার পরে নক্ষত্রের মুখের দিকে বড়ো বড়ো চোখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে ?” শুনিয়া সহসা ধুবের অত্যন্ত হাসি পাইল— এতবড়ো অসম্ভব কথা সে ইতিপূর্বে আর কখনোই শুনে নাই ; সে হাসিয়া বলিল, “তুমি কাকা ।” নক্ষত্ৰ যত নিযেধ করিতে লাগিলেন সে ততই বলিতে লাগিল, “তুমি কাকা ।” তাহার হাসিও ততই বাড়িতে লাগিল । সে নক্ষত্ররায়কে কাকা বলিয়া খেপাইতে লাগিল। নক্ষত্ৰ বলিলেন, “ধুব, তোমার দিদিকে দেখিতে যাইবে ?” ধ্রুব তাড়াতাড়ি নক্ষত্রের গলা ছাড়িয়া দাড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “দিদি কোথায় ?” নক্ষত্ৰ বলিলেন, “মায়ের কাছে ।” ধ্রুব কহিল, “মা কোথায় ?” নক্ষত্র । মা আছেন এক জায়গায় । আমি সেখানে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি । ধ্রুব হাততালি দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কখন নিয়ে যাবে কাক ?” নক্ষত্র | এখনি । ধ্রুব আনন্দে চীৎকার করিয়া উঠিয়া সজোরে নক্ষত্রের গলা জড়াইয়া ধরিল ; নক্ষত্র তাহাকে কোলে তুলিয়া লইয়া চাদরে আচ্ছাদন করিয়া গুপ্ত দ্বার দিয়া বাহির হইয়া গেলেন। আজ রাত্রেও পথে লোক বাহির হওয়া নিষেধ | এইজন্য পথে প্রহরী নাই, পথিক নাই । আকাশে পূৰ্ণচন্দ্ৰ । h মন্দিরে গিয়া নক্ষত্ররায় ধ্রুবকে রঘুপতির হাতে সমর্পণ করিতে উদ্যত হইলেন। রঘুপতিকে দেখিয়া ধ্রুব সবলে নক্ষত্ররায়কে জড়াইয়া ধরিল, কোনোমতে ছাড়িতে চাহিল না। রঘুপতি তাহাকে বলপূর্বক কাড়িয়া লইলেন । ধ্রুব “কাকা” বলিয়া কঁাদিয়া উঠিল। নক্ষত্ররায়ের চোখে জল আসিল, কিন্তু রঘুপতির কাছে এই হৃদয়ের দুর্বলতা দেখাইতে তাহার নিতান্ত লজ্জা করিতে লাগিল । তিনি ভান করিলেন যেন তিনি পাষাণে গঠিত । তখন ধ্রুব কঁাদিয়া কঁাদিয়া “দিদ” “দিদি” বলিয়া ডাকিতে লাগিল, দিদি আসিল না। রঘুপতি বজস্বরে এক ধমক দিয়া উঠিলেন। ভয়ে ধ্রুবের কান্না থামিয়া, গেল । কেবল তাহার কান্না ফাটিয়া ফাটিয়া বাহির হইতে লাগিল। চতুর্দশ দেবমূর্তি চাহিয়া রহিল । গোবিন্দমাণিক্য নিশীথে স্বপ্নে ক্ৰন্দন শুনিয়া জাগিয়া উঠিলেন । সহসা শুনিতে পাইলেন, তাহার বাতায়নের নীচে হইতে কে কাতরস্বরে ডাকিতেছে, “মহারাজ ! মহারাজ !”