পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AVOS রবীন্দ্র-রচনাবলী রঘুপতির দোষ সপ্রমাণ করিয়া রাজা তঁহাকে বলিলেন, “তোমার কী বলিবার আছে ?” রঘুপতি কহিলেন, “আমার বিচার করিবার অধিকার আপনার নাই।” রাজা কহিলেন, “তবে তোমার বিচার কে করিবে ?” রঘুপতি । আমি ব্ৰাহ্মণ, আমি দেবসেবক, দেবতা আমার বিচার করিবেন। রাজা । পাপের দণ্ড ও পুণ্যের পুরস্কার দিবার জন্য জগতে দেবতার সহস্ৰ অনুচর আছে। আমরাও তাহার একজন । সে কথা লইয়া আমি তোমার সহিত বিচার করিতে চাই না— আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, কাল সন্ধ্যাকালে বলির মানসে তুমি একটি শিশুকে হরণ করিয়াছিলে কি না । রঘুপতি কহিলেন, “ই ।” রাজা কহিলেন, “তুমি অপরাধ স্বীকার করিতেছ ?” রঘুপতি । অপরাধ ! অপরাধ কিসের ! আমি মায়ের আদেশ পালন করিতেছিলাম, মায়ের কার্য করিতেছিলাম, তুমি তাহার ব্যাঘাত করিয়াছ- অপরাধ তুমি করিয়াছ— আমি মায়ের সমক্ষে তোমাকে অপরাধী করিতেছি, তিনি তোমার বিচার করিবেন । রাজা তাহার কথার কোনো উত্তর না দিয়া কহিলেন, “আমার রাজ্যের নিয়ম এই, যে ব্যক্তি দেবতার উদ্দেশে জীব-বলি দিবে বা দিতে উদ্যত হইবে তাহার নির্বাসনদণ্ড । সেই দণ্ড আমি তোমার প্রতি প্রয়োগ করিলাম। আট বৎসরের জন্য তুমি নির্বাসিত হইলে । প্রহরীরা তোমাকে আমার রাজ্যের বাহিরে রাখিয়া আসিবে ।” প্রহরীরা রঘুপতিকে সভাগৃহ হইতে লইয়া যাইতে উদ্যত হইল। রঘুপতি তাহাদিগকে কহিলেন, “স্থির হও ।” রাজার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তোমার বিচার শেষ হইল, এখন আমি তোমার বিচার করিব, তুমি অবধান করো। চতুর্দশ দেবতা-পূজার দুই রাত্রে যে কেহ পথে বাহির হইবে, পুরোহিতের কাছে সে দণ্ডিত হইবে এই আমাদের মন্দিরের নিয়ম । সেই প্রাচীন নিয়ম। -অনুসারে তুমি আমার নিকটে দণ্ডাহঁ।” রাজা কহিলেন, “আমি তোমার দণ্ড গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত আছি।” সভাসদেরা কহিলেন, “এ অপরাধের কেবল অর্থদণ্ড হইতে পারে।” । পুরোহিত কহিলেন, “আমি তোমার দুই লক্ষ মুদ্রা দণ্ড করিতেছি। এখনই দিতে হইবে।” রাজা কিয়ৎক্ষণ ভাবিলেন, পরে বলিলেন, “তথাস্তু।” কোষাধ্যক্ষকে ডাকিয়া দুই লক্ষ মুদ্রা আদেশ করিয়া দিলেন । প্রহরীরা রঘুপতিকে বাহিরে লইয়া গেল । রঘুপতি চলিয়া গেলে নক্ষত্ররায়ের দিকে চাহিয়া রাজা দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “নক্ষত্ররায়, তোমার অপরাধ তুমি স্বীকার কর কি না।” নক্ষত্ররায় বলিলেন, “মহারাজ, আমি অপরাধী, আমাকে মার্জন করুন ।” বলিয়া ছুটিয়া আসিয়া রাজার পা জড়াইয়া ধরিলেন । মহারাজ বিচলিত হইলেন, কিছুক্ষণ বাক্যস্ফুর্তি হইল না। অবশেষে আত্মসম্বরণ করিয়া বলিলেন, “নক্ষত্ররায়, ওঠে, আমার কথা শোনো । আমি মার্জনা করিবার কে ? আমি আপনার শাসনে আপনি বদ্ধ। বন্দীও যেমন বদ্ধ, বিচারকও তেমনি বদ্ধ। একই অপরাধে আমি একজনকে দণ্ড দিব, একজনকে মার্জনা করিব, এ কী করিয়া হয় ? তুমিই বিচার করো ।” সভাসদেরা বলিয়া উঠিলেন, “মহারাজ, নক্ষত্ররায় আপনার ভাই, আপনার ভাইকে মার্জন করুন ।” রাজা দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “তোমরা সকলে চুপ করো। যতক্ষণ আমি এই আসনে আছি, ততক্ষণ আমি কাহারও ভাই নহি, কাহারও বন্ধু নাহি ।” সভাসদেরা চারি দিকে চুপ করিলেন। সভা নিস্তব্ধ হইল। রাজা গভীর স্বরে কহিতে লাগিলেন, “তোমরা সকলেই শুনিয়াছ- আমার রাজ্যের নিয়ম এই যে, যে ব্যক্তি দেবতার উদ্দেশে জীব-বলি দিবে বা দিতে উদ্যত হইবে তাহার নির্বাসনদণ্ড ৷ কাল সন্ধ্যাকালে নক্ষত্ররায় পুরোহিতের সহিত