পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ANObr রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া বলিলেন, “আহা, ত্রিপুরার রাজা মস্ত রাজা ।” রঘুপতি তাহা সম্পূর্ণ অনুমোদন করিলেন। খুড়াসাহেব । ঠাকুরের কী করা হয় ? রঘুপতি । আমি ত্রিপুরার রাজপুরোহিত । খুড়াসাহেব চোখ বুজিয়া মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “আহা !” রঘুপতির উপরে তাহার ভক্তি অত্যন্ত दांख्रिशा उंठिंब्ल । - “কী করিতে আসা হইয়াছে ?” রঘুপতি কহিলেন, “তীর্থদর্শন করিতে।” ধুম করিয়া আওয়াজ হইল। শত্রুপক্ষ দুৰ্গ আক্রমণ করিয়াছে। খুড়াসাহেব হাসিয়া চােখ টিপিয়া কহিলেন, “ও কিছু নয়, ঢেলা ছুড়িতেছে।” বিজয়গড়ের উপরে খুড়াসাহেবের বিশ্বাস যত দৃঢ়, বিজয়গড়ের পাষাণ তত দৃঢ় নহে। বিদেশী পথিক দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করিলেই খুড়াসাহেব তাহাকে সম্পূর্ণ অধিকার করিয়া বসেন এবং বিজয়গড়ের মাহাত্ম্য তাহার মনে বদ্ধমূল করিয়া দেন। ত্রিপুরার রাজবাটী হইতে রঘুপতি আসিয়াছেন, এমন অতিথি সচরাচর মেলে না, খুড়াসাহেব অত্যন্ত উল্লাসে আছেন। অতিথির সঙ্গে বিজয়গড়ের পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিলেন । তিনি বলিলেন, ব্ৰহ্মার অণ্ড এবং বিজয়গড়ের দুর্গ যে প্রায় একই সময়ে উৎপন্ন হইয়াছে এবং ঠিক মনুর পর হইতেই মহারাজ বিক্রমসিংহের পূর্বপুরুষেরা যে এই দুর্গ ভোগদখল করিয়া আসিতেছেন সে বিষয়ে কোনাে সংশয় থাকিতে পারে না । এই দুর্গের প্রতি শিবের কী বর আছে এবং এই দুর্গে কর্তবীৰ্যার্জন যে কিরূপে বন্দী হইয়াছিলেন তাহাও রঘুপতির অগোচর রহিল না । । সন্ধ্যার সময় সংবাদ পাওয়া গেল শত্রুপক্ষ দুর্গের কোনো ক্ষতি করিতে পারে নাই। তাহারা কামান পাতিয়াছিল, কিন্তু কামানের গোলা দুর্গে আসিয়া পৌছিতে পারে নাই। খুড়াসাহেব হাসিয়া রঘুপতির দিকে চাহিলেন । মর্ম এই যে, দুর্গের প্রতি শিবের যে অমোঘ বির আছে তাহার এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ আর কী হইতে পারে। বোধ করি, নন্দী স্বয়ং আসিয়া কামানের গোলাগুলি লুফিয়া লইয়া গিয়াছে, কৈলাসে গণপতি ও কার্তিকেয় ভাটা খেলিবেন । দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ শাসুজাকে কোনোমতে হস্তগত করাই রঘুপতির উদ্দেশ্য ছিল । তিনি যখন শুনিলেন, সুজা দুর্গ আক্রমণ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন তখন মনে করিলেন মিত্রভাবে দুর্গের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তিনি কোনোরূপে সুজার দুর্গ-আক্রমণে সাহায্য করিবেন । কিন্তু ব্ৰাহ্মণ যুদ্ধবিগ্রহের কোনো ধার ধারেন না, কী করিলে যে সুজার সাহায্য হইতে পারে কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না। V পরদিন আবার যুদ্ধ আরম্ভ হইল। বিপক্ষ পক্ষ বারুদ দিয়া দুর্গপ্রাচীরের কিয়দংশ উড়াইয়া দিল কিন্তু ঘন ঘন গুলিবর্ষণের প্রভাবে দুর্গে প্রবেশ করিতে পারিল না । ভগ্ন অংশ দেখিতে দেখিতে গাথিয়া তোলা হইল। আজ মাঝে মাঝে দুর্গের মধ্যে গোলাগুলি আসিয়া পড়িতে লাগিল, দুই-চারিজন করিয়া দুৰ্গ সৈন্য হত ও আহত হইতে লাগিল । “ঠাকুর, কিছু ভয় নাই, এ কেবল খেলা হইতেছে৷” বলিয়া খুড়াসাহেব রঘুপতিকে লইয়া দুর্গের চারি দিক দেখাইয়া বেড়াইতে লাগিলেন । কোথায় অস্ত্রাগার, কোথায় ভাণ্ডার, কোথায় আহতের চিকিৎসাগৃহ, কোথায় বন্দীশালা, কোথায় দরবার, এই সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া দেখাইতে লাগিলেন ও বার বার রঘুপতির মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন। রঘুপতি কহিলেন, “চমৎকার কারখানা । ত্রিপুরার গড় ইহার কাছে লাগিতে পারে না। কিন্তু সাহেব, গোপনে পলায়নের জন্য ত্রিপুরার গড়ে একটি আশ্চর্য সুরঙ্গ-পথ আছে, এখানে সেরূপ কিছুই দেখিতেছি না।”