পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8 \Ն) রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রাজ্যের গুরুভারে ননির পুতলি মেহের ভাই কখনো ব্যথিত হইয়া পড়ে। সে রাজ্যে আর কি কখনে সহজে প্ৰবেশ করিতে পরিবে নির্বোধি !” নক্ষত্ররায় তাড়াতাড়ি বলিলেন, “আমি কি এই সামান্য কথাটা আর বুঝি না! আমি সমস্তই বুঝিকিন্তু আমি কী করিব বলো ঠাকুর, উপায় কী ?” a রঘুপতি । সেই উপায়ের কথাই তো হইতেছে। সেইজন্যই তো আসিয়াছি। ইচ্ছা হয় তো আমার সঙ্গে চলিয়া আইস, নয় তো এই বঁাশবনের মধ্যে বসিয়া বসিয়া তোমার হিতাকাঙক্ষী দাদার ধান করো। আমি চলিলাম। বলিয়া, রঘুপতি প্ৰস্থানের উদযোগ করিলেন । নক্ষত্ররায় তাড়াতাড়ি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া কহিলেন, “আমিও যাইব ঠাকুর, কিন্তু দেওয়ানজি যদি যাইতে চান তাহাকে আমাদের সঙ্গে লইয় যাইতে কি আপত্তি আছে ?” রঘুপতি কহিলেন, “আমি ছাড়া আর কেহ সঙ্গে যাইবে না ।” বাড়ি ছাড়িয়া নক্ষত্ররায়ের পা সরিতে চায় না। এই-সমস্ত সুখের খেলা ছাড়িয়া, দেওয়ানজিকে ছাড়িয়া, রঘুপতির সঙ্গে একলা কোথায় যাইতে হইবে ! কিন্তু রঘুপতি যেন তাহার কেশ ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিলেন । তাহা ছাড়া নক্ষত্ররায়ের মনে একপ্রকার ভয়মিশ্রিত কৌতুহলও জন্মিতে লাগিল তাহারও একটা ভীষণ আকর্ষণ আছে । নীেকা প্ৰস্তুত আছে। নদীতীরে উপস্থিত হইয়া নক্ষত্ররায় দেখিলেন, কঁধে গামছা ফেলিয়া পীতাম্বর স্নান করিতে আসিয়াছেন। নক্ষত্ৰকে দেখিয়াই পীতাম্বর হাস্যবিকশিত মুখে কহিলেন, “জয়েস্তু মহারাজ ! শুনিলাম নাকি কাল কোথা হইতে এক অলক্ষণমন্ত বিটল ব্ৰাহ্মণ আসিয়া শুভবিবাহে? ব্যাঘাত করিয়াছে।” নক্ষত্ররায় অস্থির হইয়া পড়িলেন । রঘুপতি গভীরস্বরে কহিলেন, “আমিই সেই বিটল ব্ৰাহ্মণ । পীতাম্বর হাসিয়া উঠিলেন ; কহিলেন, “তবে তো আপনার সাক্ষাতে আপনার বর্ণনা করাটা ভালে হয় নাই। জানিলে কোন পিতার পুত্র এমন কাজ করিত ! কিছু মনে করিবেন না ঠাকুর, অসাক্ষাতে লোকে কী না বলে ! আমাকে যাহারা সম্মুখে বলে রাজা, তাহারা আড়ালে বলে পিতু । মুখের সামনে কিছু না বলিলেই হইল, আমি তো এই বুঝি । আসল কথা কী জানেন, আপনার মুখটা কেমন ভারি অপ্ৰসন্ন দেখাইতেছে, কাহারও এমন মুখের ভাব দেখিলে লোকে তাহার নামে নিন্দ রটায়। মহারাজ, এত প্ৰাতে যে নদীতীরে ?” নক্ষত্ররায় কিছু করুণ স্বরে কহিলেন, “আমি যে চলিলাম দেওয়ানজি ।” পীতাম্বর । চলিলেন ? কোথায় ? ন-পাড়ায়, মণ্ডলদের বাড়ি ? নক্ষত্র । না দেওয়ানজি, মণ্ডলদের বাড়ি নয়। অনেক দূর । পীতাম্বর। অনেক দূর ? তবে কি পাইকঘাটায় শিকারে যাইতেছেন ? নক্ষত্ররায় একবার রঘুপতির মুখের দিকে চাহিয়া কেবল বিষন্নভাবে ঘাড় নাড়িলেন । রঘুপতি কহিলেন, “বেলা বহিয়া যায়, নীেকায় উঠা হউক ৷” পীতাম্বর অত্যন্ত সন্ধিগ্ধ ও ক্রুদ্ধ ভাবে ব্ৰাহ্মণের মুখের দিকে চাহিলেন ; কহিলেন, “তুমি কে ঠেং ঠাকুর ? আমাদের মহারাজকে হুকুম করিতে আসিয়াছ!” ቀና নক্ষত্র ব্যস্ত হইয়া পীতাম্বরকে এক পাশে টানিয়া লইয়া কহিলেন, “উনি আমাদের গুরুঠাকুর ; পীতাম্বর বলিয়া উঠিলেন, “হােক-না গুরুঠাকুর । উনি আমাদের চণ্ডীমণ্ডপে থাকুন, চাল-কল বরাদ করিয়া দিব, সমাদরে থাকিবেন- মহারাজকে উহার কিসের আবশ্যক ?” রঘুপতি। বৃথা সময় নষ্ট হইতেছে- আমি তবে চলিলাম। পীতাম্বর। যে আজ্ঞে, বিলম্বে ফল কী, মশায় চাটুপটু সরিয়া পড়ুন। মহারাজকে লইয়া আদি প্ৰাসাদে যাইতেছি ।