পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ8Գ নক্ষত্ররায় একবার রঘুপতির মুখের দিকে চাহিয়া একবার পীতাম্বরের মুখের দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “না দেওয়ানজি, আমি যাই ।” পীতাম্বর। তবে আমিও যাই, লোকজন সঙ্গে লউন । রাজার মতো চলুন । রাজা যাইবেন, সঙ্গে দেওয়ানজি যাইবে না ? নক্ষত্ররায় কেবল রঘুপতির মুখের দিকে চাহিলেন । রঘুপতি কহিলেন, “ কেহ সঙ্গে যাইবে না।” পীতাম্বর উগ্ৰ হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “দেখো ঠাকুর, তুমি—” নক্ষত্ররায় তাহাকে তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, “ দেওয়ানজি, আমি যাই, দেরি হইতেছে।” পীতাম্বর স্নান হইয়া নক্ষত্রের হাত ধরিয়া কহিলেন, “দেখো বাবা, আমি তোমাকে রাজা বলি, কিন্তু আমি তোমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসি— আমার সন্তান কেহ নাই । তোমার উপর আমার জোর খাটে না । তুমি চলিয়া যাইতেছ, আমি জোর করিয়া ধরিয়া রাখিতে পারি না । কিন্তু আমার একটি অনুরোধ এই আছে, যেখানেই যাও আমি মরিবার আগে ফিরিয়া আসিতে হইবে । আমি স্বহস্তে আমার রাজত্ব সমস্ত তোমার হাতে দিয়া যাইব । আমার এই একটি সাধ আছে ।” নক্ষত্ররায় ও রঘুপতি নীেকায় উঠিলেন। নীেক দক্ষিণমুখে চলিয়া গেল। পীতাম্বর স্নান ভুলিয়া গামছা-কঁধে অন্যমনস্কে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন । গুজুরপাড়া যেন শূন্য হইয়া গেল— তাহার আমোদ-উৎসব সমস্ত অবসান । কেবল প্রতিদিন প্রকৃতির নিত্য উৎসব, প্ৰাতে পাখির গান, পল্লবের মর্মরধবনি ও নদীতরঙ্গের করতালির বিরাম নাই । সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ দীর্ঘ পথ । কোথাও বা নদী, কোথাও বা ঘন অরণ্য, কোথাও বা ছায়াহীন প্ৰান্তর- কখনো বা নীেকায়, কখনো বা পদব্রজে, কখনো বা টাটু ঘোড়ায়— কখনো রৌদ্র, কখনো বৃষ্টি, কখনো কোলাহলময় দিন, কখনো নিশীথিনীর নিস্তব্ধ অন্ধকার- নক্ষত্ররায় অবিশ্রাম চলিয়াছেন । কত দেশ, কত বিচিত্র দৃশ্য, কত বিচিত্র লোক- কিন্তু নক্ষত্ররায়ের পার্শ্বে ছায়ার ন্যায় ক্ষীণ, রৌদ্রের ন্যায় দীপ্ত সেই একমাত্র রঘুপতি অবিশ্রাম লাগিয়া আছেন । দিনে রঘুপতি, রাত্রে রঘুপতি, স্বপ্নেও রঘুপতি বিরাজ করেন। পথে পথিকেরা যাতায়াত করিতেছে, পথপার্থে ধুলায় ছেলেরা খেলা করিতেছে, হাটে শত শত মাঝিরা গান গাহিয়া চলিয়াছে— কিন্তু নক্ষত্ররায়ের পার্থে এক শীর্ণ রঘুপতি সর্বদা জাগিয়া আছে । জগতে চারি দিকে বিচিত্র খেলা হইতেছে, বিচিত্ৰ ঘটনা ঘটিতেছে- কিন্তু এই রঙ্গভূমির বিচিত্ৰ লীলার লোকালয় কেবল শূন্য মরুভূমি । 赫 ছায়া উত্তর করে, “অনেক দূর ।” “কোথায় যাইতে হইবে ?” তাহার উত্তর নাই। নক্ষত্ররায় নিশ্বাস ফেলিয়া চলিতে থাকেন। তরুশ্রেণীর মধ্যে পাত-দিয়া-ছাওয়া নিভৃত পরিচ্ছন্ন কুটির দেখিলে তাহার মনে হয়, ‘আমি যদি এই কুটিরের অধিবাসী হাইতাম !" গােধূলির সময় যখন রাখাল লাঠি কঁাধে করিয়া মাঠ দিয়া গ্রামপথ দিয়া ধূলা উড়াইয়া গোরু গিয়া বিশ্রাম করিতে পাইতাম !” মধ্যাহ্নে প্ৰচণ্ড রৌদ্রে চাষা চাষ করিতেছে, তাহাকে দেখিয়া নক্ষত্ররায় মনে করেন, “আহা, এ কী সুখী !” কৃষ্ট নক্ষত্ররায় বিবৰ্ণ শীর্ণ মলিন হইয়া গিয়াছেন , রঘুপতিকে বলেন, "ঠাকুর, আমি আর চব না ।”